একজন ট্রু ন্যাশনালিস্টের বিদায় : বিএনপি নেতৃত্বের দৈন্যতা না বশ্যতা

ফয়সাল আকবর |♦|

ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান, একজন প্রচারবিমুখ গবেষক এবং খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। একজন ট্রু ন্যাশনালিস্ট বলতে যা বুঝায় তাঁর প্রায় সব গুণ ধারণ করতেন তিনি। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পরম পরীক্ষীত এক বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নিয়ে তাঁর বক্তব্যটি মূলত বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের মতের প্রতিফলন। তিনি বলেছিলেন, “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারণা। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি বর্জনমূলক ধারণা। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ-বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্য ভাষাভাষী লোকজনকে বাদ দিয়ে কেবল বাংলা ভাষাভাষী লোকজনের কথা বলে। অন্যদিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ- ভূখণ্ডগত জাতীয়তাবাদ। এটি এই ভূখণ্ডে থাকা ধর্ম, বর্ণ, নৃতাত্ত্বিক অবস্থান-নির্বিশেষে সবার কথা বলে।” বাস্তব প্রেক্ষিতে এই ভূখন্ডের মানুষও ব্রাহ্মণ শ্রেণীর বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে সবসময় স্বাগত জানায়। তাঁর চিন্তা ও লেখনি বাংলাদেশ ও তার জনগণের পক্ষের এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের একাডেমিক বিকাশের অন্যতম অনুঘটক ছিল। তিনি যে কাজ করে গেছেন তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক তরুণদের প্রচন্ড রকম ভালবাসার উৎস হয়ে থাকবে।

ড. তালুকদার মনিরুজ্জামানের মতো প্রথিতযশা একাডেমিশিয়ান বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে নেই বললেই চলে। তিনি কানাডার কুইন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে করেছেন পিএইচডি। ইউনির্ভার্সিিট অব লন্ডন এবং ওয়াশিংটন ডিসির উড্রাে উইলসন সেন্টারের ছিলেন ফেলো। তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার থেকে দেওয়া হয়েছিল Bicentennial Medal। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান- সিকউরিটি অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের গর্ভনিং বডির প্রতিষ্টাতা সদস্য। ছিলেন স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের স্কলার। রাজনীতি, নিরাপত্তা এবং বাংলাদেশ নিয়ে লিখে গেছেন বেশ কয়েকটি গ্রন্থ যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘মিলিটারি উইথড্রয়াল ফ্রম পলিটিক্স – এ কম্পারেটিভ স্টাডি’ আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত। ১৯৮৭ সালে বইটি যুক্তরাষ্ট্রের বেলিঞ্জার পাবলিকেন্স থেকে প্রকাশিত হয়। তার লেখা আরেকটি বিখ্যাত গ্রন্থ The Security of Small State in the Third World। বইটি ১৯৮২ সালে Australian National University, Canberra, এবং England এবং Florida, USA থেকে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও তাঁর সাড়া জাগানো গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- Group interests and political changes: Studies of Pakistan and Bangladesh; Radical politics and the emergence of Bangladesh; Politics and security of Bangladesh; The Bangladesh revolution and it’s aftermath। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ইউিনভার্সিটিতে তাঁর সামরিক অধ্যয়ন সংক্রান্ত বইগুলো পড়ানো হয়।

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ-এর প্রকৃত ধারক এই নিভৃতচারী মানুষটি গত ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ পৃথিবী থেকে চলে গেলেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পরম বন্ধু মানুষটির এই দুঃসময়ে চলে যাওয়াটা নিঃসন্দেহে জাতীয় জীবনে অনেক বড় মাপের ক্ষতি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জাতীয়তাবাদের পরম শুভাকাঙ্খী এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর বিদায়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারক ও বাহক পরিচয়ে ৪০ বছর ধরে রাজনীতি করা বিএনপি নূন্যতম সৌজন্যতাবোধ দেখায়নি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ- রাজনীতির ঊর্ধ্বে এসে যে উদারতা দেখানোর কথা তা দেখায়নি- তাতে আমার আক্ষেপ কিংবা ক্ষোভ কোনটাই নেই। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্ব কেন এতবড় মাপের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের এতবড় বুদ্ধিজীবীর জানাজায় হাজির হননি- তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। অথচ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনায় সিভিল মিলিটারি রিলেশন ডেভেলপমেন্ট-এর বিষয়ে তাঁর পরামর্শ নিয়ে চলতেন। ২০০৬ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিজেই ড. তালুকদার মনিরুজ্জামানকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। আমার স্মৃতিতে মনে পড়ে, ২০১০ কিংবা ২০১১ সালে সুধীজনদের নিয়ে ২০ দলীয় জোটের ইফতার মাহফিলে বেগম খালেদা জিয়া ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান এবং তাঁর সহধর্মিনী ড. রাজিয়া আক্তার বানুকে তাঁর পাশেই বসিয়ে ইফতার করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান একমাত্র ব্যক্তি যিনি খালেদা জিয়াকে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আর সেই ব্যক্তির জানাজায় বিএনপির কোন নেতা আসেননি; ড. মনিরুজ্জামানের বন্ধু ব্যরিস্টার মওদুদও আসেননি; এমনকি ড. এমাজউদ্দীন আহমদ-ড. মাহবুবউল্লাহ- ডা. জাফরুল্লাহসহ বাংলাদেশী জাতীয়তবাদের ধারক-বাহক বলে বক্তব্য দেওয়া মানুষগুলোও আসেননি। এত বড় মাপের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর বিদায়ে বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের এই অনুপস্থিতি কিসের নির্দেশ করে তা আমার কাছে বোধগম‌্য নয়। এটা কি বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের দৈন্যতা না বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের তথাকথিত ধারক ও বাহকদের বশ্যতা স্বীকার!!!

স্ট্রাটেজিক আলোচনায় এটা বলতেই হবে, ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান শুধু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশকে রক্ষার একজন দার্শনিক। যিনি সব সময় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতেন। বাংলাদেশকে ভারতের আধিপত্য থেকে বাঁচাতে যিনি প্রথম একাডেমিক্যালি কাজ করেছেন তিনি হচ্ছেন তালুকদার মনিরুজ্জামান। যে কাজ ভারতীয় আধিপাত্যবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের টিকে থাকার মুল ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। তাঁকে ভুলে যাওয়ার মানে- বাংলাদেশের পক্ষের শক্তির সাথে একধরনের বিশ্বাসঘাতকতা। যে বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতি- বিদায় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ!

লেখকঃ সাংবাদিক ফয়সাল আকবর

# ফেসবুক পোস্ট

Print Friendly, PDF & Email