রাষ্ট্র সঠিক পথে থাকলে আর কোনো নুসরাতকে এভাবে প্রাণ দিতে হবে না

রাশেদা কে চৌধুরী‌‌|

ফেনীর সোনাগাজীতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফির কথা আজ খুব মনে পড়ছে। ওই জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ঘোষিত রায়ে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত ১৬ আসামিই যেভাবে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছে, তা প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু নুসরাতকে হারানোর বেদনা তাতে কতটা উপশম হবে জানি না। প্রাণবন্ত একটি মেয়েকে এই খুনিরা যেভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে; শেষ দিনগুলোতে হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে সে যেভাবে চরম শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছে; তাতে করে তাদের বিন্দুমাত্র অনুকম্পা পাওয়ার অধিকার থাকে না।

এই রায় শোনার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমি সংশ্নিষ্টদের কৃতজ্ঞতা জানাই। ৩৩ দিনে তদন্ত এবং ৬১ দিন মামলার কার্যক্রম- সব মিলিয়ে একশ’ দিনেরও কমে নুসরাত ও তার পরিবার বিচার পেয়েছে। কেবল নুসরাত নয়, আমি মনে করি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও যেন তাদের প্রত্যাশিত রায় পেয়েছে। এই সুযোগে আমি মহামান্য আদালতকে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই। আমরা জানি, অনেক মামলার প্রত্যাশিত রায়ই সহজে পাওয়া যায় না মামলা প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে। এমনকি অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার রায়ও আমরা সহজে পাই না। আবার চাঞ্চল্যকর মামলা হয়েও সাক্ষী ও প্রমাণের অভাবে আসামিরা খালাস পেয়ে যায়- এমনও দেখেছি।

নুসরাত হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবস্তরে যথাযথ নির্দেশনা দিয়েছেন, আমরা দেখেছি। ফলে প্রথম দিকে পুলিশের গড়িমসি থাকলেও পরবর্তী সময়ে তদন্ত, আসামি গ্রেফতার, অভিযোগপত্র গঠন- সব পর্যায়ে পুলিশ ও প্রশাসন আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছে। নুসরাতের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করার কৃতিত্ব তাদেরও। তাদেরও আমি বাংলাদেশের নারী সমাজের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই।

নারী আন্দোলন ও মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমি মনে করি- নুসরাত হত্যাকাণ্ডের এই রায়ের মধ্য দিয়ে তিনটি সতর্কতা সংকেত যাবে সর্বস্তরে। প্রথমত, এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। দ্বিতীয়ত, যে বা যারাই অপরাধ করুক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে যত প্রভাবশালী হোক, তাদের শাস্তি হবেই। তৃতীয়ত, আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। তৃতীয়ত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ করতে হবে।

দেশের শিক্ষা পরিবারের কর্মী হিসেবে আমাকে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের যে দিকটি বিশেষভাবে আহত করেছিল, তা হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের সন্তানের নিরাপত্তাহীনতা। নুসরাত তার মাদ্রাসার খোদ অধ্যক্ষের হাতে নিগৃহীত হয়েছিল। আইনি পদক্ষেপ নেওয়ায় ‘ক্ষুব্ধ’ ওই অধ্যক্ষের নির্দেশেই তাকে পুড়িয়ে হত্যা করেছিল একই মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। বিষয়টি ভাবতেও যেন গা শিউরে ওঠে।

অথচ আমরা সাধারণভাবে মনে করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। পরিবার মনে করে, আমরা নাগরিক সমাজ মনে করি, সাধারণ মানুষ মনে করে। নুসরাতের হত্যাকারীরা সেই সাধারণ ধারণায় বড় ধরনের নাড়া দিয়েছিল। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের এই রায়ের পর এখন সময় এসেছে সতর্ক হওয়ার- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো নিরাপদ স্থানে কেউ যেন আর অপরাধ ঘটানোর দুঃসাহস না দেখায়। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এ ব্যাপারে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আমি মনে করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

আমি আশা করি, নিম্ন আদালতে ঘোষিত নুসরাত হত্যাকাণ্ডের রায়ও দ্রুত কার্যকর হবে। আমাদের দেশে রায় দ্রুত হলেও অনেক সময় বাস্তবায়ন ধীরগতিতে হয়। কিন্তু রায় কার্যকর দ্রুত না হলে এই দ্রুত বিচারের সুফল আমরা পাব না। স্বীকার করি, যারা অপরাধ করেছে তাদেরও আইনি অধিকার আছে। এ ক্ষেত্রে ঘটনাটির তদন্ত ও মামলা প্রক্রিয়া যেভাবে দ্রুত সম্পন্ন হয়েছে, এই মামলার পরবর্তী স্তরগুলোও দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। রায় ঘোষণার পর যেমন জনসাধারণের মধ্যে স্বস্তি নেমে এসেছে, রায়ের বাস্তবায়ন দীর্ঘায়িত হলেও তেমনই হতাশা নেমে আসতে পারে।

আমি জানি, নুসরাত হত্যাকাণ্ড চাঞ্চল্যকর ছিল। যে কারণে রাষ্ট্র ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে গুরুত্ব পেয়েছে। তাহলে ‘চাঞ্চল্যকর’ না হলেই কি হত্যা ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি বা পরিবারের দ্রুত বিচার পাওয়ার সুযোগ থাকবে না? আমি মনে করি, স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে- এমন যে কোনো মামলার তদন্ত, বিচার প্রক্রিয়া ও বাস্তবায়ন দ্রুতগতিতে করতে হবে। তাহলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে। এটাও মনে রাখতে হবে, অপরাধীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে প্রভাবশালী। অন্যদিকে অপরাধের শিকার ব্যক্তি বা পরিবার সাধারণত দুর্বল হয়। ফলে মামলা ও বিচার প্রক্রিয়া যদি দীর্ঘসূত্র হয়, তাহলে একপর্যায়ে গিয়ে আক্রান্ত অথচ দুর্বল পক্ষ বিবাদী পক্ষের সঙ্গে দৌড়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না। দ্রুত বিচার সে কারণেও জরুরি।

নুসরাত হত্যাকাণ্ডের রায় স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনীতিকের জন্যও একটি কঠোর বার্তা। এতে প্রমাণ হয়েছে, পুলিশ ও প্রশাসন আইনি প্রক্রিয়ায় গড়িমসি করেও পার পাবে না। আর স্থানীয় রাজনীতিকরা অপরাধীদের অন্যায় আশ্রয়-প্রশয় দিলে শেষ পর্যন্ত তাদেরও হত্যার দায় নিতে হবে। আমি প্রত্যাশা করব, ফেনীর এই উদাহরণ দেশের অন্যান্য অংশের পুলিশ ও প্রশাসন মনে রাখবে।

নুসরাত হত্যাকাণ্ডের রায় আরেকটি বিষয় স্পষ্ট করেছে- পুলিশ যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, যদি তাদের মধ্যে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকে; তাহলে অপরাধীকে শনাক্ত, আটক ও আইনের আওতায় আনা কঠিন হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অঙ্গীকারও বড় ভূমিকা পালন করে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে, তাহলে এর প্রতিফলন স্থানীয় রাজনীতিতেও দেখা যাবে। ফেনীর মতো স্থানীয় রাজনীতিকরা অপরাধীদের আশ্রয় দেবে না।

চাঞ্চল্যকার মামলাগুলোর ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমেরও ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফেনীতে আমরা দেখেছি, প্রথমে কিছু সংবাদমাধ্যমের স্থানীয় প্রতিনিধিরা নেতিবাচক ভূমিকা রাখলেও পরবর্তী সময়ে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের সাংবাদিকদের হস্তক্ষেপে তা দূর হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা কেবল জনমত গঠন নয়, সেটাকে জাগ্রত রাখার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা নাগরিকরা এক একটি ঘটনা আসে আর ক্ষোভ প্রকাশ করি। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব হচ্ছে, সেসব ঘটনার ‘ফলোআপ’ করা। ওইসব ঘটনা বা অপরাধের ব্যাপারে শুধু প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেৃতত্বকে নয়, সাধারণ মানুষকে জাগ্রত রাখা। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম এই ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। তারাও নাগরিকদের সাধুবাদ পেতে পারে।

নুসরাত হত্যাকাণ্ডে জনমত গঠনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল। যদিও ভোলার ক্ষেত্রে আমরা এর নেতিবাচক ভূমিকা দেখছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসলে ছুরির মতো। সার্জেনের হাতে থাকলে প্রাণ বাঁচাতে পারে; আবার সন্ত্রাসীর হাতে থাকলে প্রাণ নিতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমরা সার্জেনের মতো, না সন্ত্রাসীর মতো ব্যবহার করব- এই সিদ্ধান্ত নাগরিকদের নিতে হবে।

নুসরাতের ঘটনা থেকে অভিভাবকদের জন্য বাড়তি শিক্ষা হলো- সন্তানের খোঁজখবর করতে হবে। তাকে সময় দিতে হবে। আমার সন্তান কোথায়, কার সঙ্গে কী করছে, মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে কি-না, উগ্রবাদের দ্বারা প্রভাববিত হচ্ছে কি-না; সব দেখার দায়িত্ব অভিভাবকের। এখন সবার হাতে হাতে সেলফোন। সেই সেলফোনে কী করছে, এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে অবশ্যই। নুসরাতের হত্যাকারীদের কয়েকজনের বয়স বেশি নয়। তাদের অভিভাবকরা যদি সতর্ক থাকত, তাহলে হয়তো তারা এভাবে অপরাধী হয়ে উঠতে পারত না।

নুসরাত হত্যাকাণ্ড ও তার বিচার থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যদি সজাগ ও সতর্ক থাকি; তাহলে দেশ ঠিক থাকবে। বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ যদি দায়িত্ব পালন করে; তাহলে রাষ্ট্র সঠিক পথে থাকবে। নাগরিক সচেতনতা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার যদি থাকে; তাহলে আর কোনো নুসরাতকে এভাবে প্রাণ দিতে হবে না।

নারী ও মানবাধিকার কর্মী; সাবেক তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের উপদেষ্টা

Print Friendly, PDF & Email