• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

ইসলাম কী, মুসলিম কারা?

মুহম্মদ নূরুল ইসলাম◾

সকল প্রশংসা সেই সত্তার যার হাতের মুঠোতে আমার জীবন-মৃত্যু। সকল প্রশংসা তাঁরই যিনি আমাকে অসংখ্য নিয়ামত দান করেছেন, শুকরিয়া প্রকাশ করছি রাব্বুল আলামিনের যিনি আমার কলমকে সচল রেখেছেন। সে রবের কাছে লাখো-কোটি শুকরিয়া যিনি আমাকে মুসলিম বা মুসলমান সম্পর্কে কিছু লেখার জন্য সাহায্য করেছেন, দিয়েছেন জ্ঞান।
অসংখ্য দরুদ ও সালাম বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত, মহান শিক্ষক সাইয়্যিদুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি, যিনি আল্লাহর দীনকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। যিনি পৃথিবীর ইতিহাসে এক ঘোরতর জাহেলিয়াতের যুগে আবির্ভূত হয়ে ইসলামের দাওয়াতের মাধ্যমে জাহেলিয়াতের পংকিলতায় নিমজ্জিত জাতিকে তাওহিদি চেতনায় উদ্ভাসিত ও আলোকিত করেছেন।

ভূমিকা
বর্তমান বিশ্বে প্রায় ১৭০ কোটি মুসলিম বা মুসলমান আছে বলে আমরা একটা ধারণা পাই। আমরা স্বাভাবিকভাবেই মনে করি, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত, যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী তারাই মুসলিম। তাছাড়াও বাংলা অভিধানেও মুসলিম শব্দের অর্থ তাই লিখা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা অভিধানের সেই শব্দটাই শিক্ষার্থীদের মগজে ঢুকে যায়, তা আর বের হয় না। বের হওয়ার কোনো কারণও নেই। কারণ তার কোনো বিকল্প অর্থ থাকতে পারে বা মুসলিম অর্থ অন্য কিছু হতে পারে তা ভাববার অবকাশ কই? প্রকৃত অর্থে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মতেরাই শুধুমাত্র মুসলিম নয়। আদি পিতা হযরত আদম আ. ও মা হাওয়া আ. মুসলিম ছিলেন। আল্লাহ তা’আলা কুরআন করিমের একাধিক স্থানে মুসলিমের সংজ্ঞা নিয়ে এরশাদ করেছেন।
রাব্বুল আলামিন যদি তওফিক দান করেন তাহলে, আমি আমার এই নিবন্ধে মুসলিম সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়ার চেষ্ঠা করবো।

মুসলিম শব্দের অর্থ
প্রশ্ন এসেছে মুসলিম বা মুসলমান শব্দের অর্থ কী?
মুসলমান বা মুসলিম শব্দের অর্থ লিখতে গিয়ে বাঙলা ভাষায় প্রচলিত বিভিন্ন অভিধানে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। বাংলা একাডেমি ও কলিকাতা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত অভিধানে মুসলিম শব্দের অর্থ কি লিখেছে তা আমরা দেখে নিতে পারি।
বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পরিমার্জিত সংস্করণ : পৌষ ১৪০৭/ ডিসেম্বর ২০০০। দ্বিতীয় সংস্করণ : অগ্রহায়ণ ১৩৯৯/ নভেম্বর ১৯৯২। পুনর্মুদ্রণ : ভাদ্র ১৪১০/ সেপ্টেম্বর ২০০৩।-এ মুসলমান, মুছলমান, মুসলিম, মোসলেম (মুসলমান-ছ-, মুসলিম, মোস্-) বি. হজরত মুহম্মদ সা. কর্তৃক প্রবর্তিত ইসলাম ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায় বা ব্যক্তি। ০ বিণ. ১. ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। ২. ইসলাম ধর্ম বা মুসলমান সম্পর্কিত।
মুসলিম বি. ১. মুসলমানদের রীতি। ২. খৎনা; সুন্নৎ; ত্বকচ্ছেদ। ৩. মুসলমান ধর্মাবলম্বিনী নারী। ০ বিণ. মুসলমানের ধর্ম সংক্রান্ত। (আ. মুসলিম, ফা. মুসলমান).।
সংসদ বাঙ্গালা অভিধান, সংশোধিত ও পরিবর্ধিত চতুর্থ সংস্করণ, সাহিত্য সংসদ, ৩২৩ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড, কলিকাতা-৯। ত্রয়োবিংশতিতম মুদ্রণ আগস্ট ১৯৯৯, পৃষ্ঠা- ৫৮৫- এ মুসলমান, মুসলিম – (১) বি. হজরত মোহাম্মদ কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায় বা ব্যক্তি। (২) বিণ. হজরত মোহাম্মদ কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্মসম্বন্ধীয় বা ধর্মাবলম্বী। (ফা. মুসলমান, আ. মুসলিম)।
উপরের দুইটি অভিধানে মুসলিম বা মুসলমান শব্দের অর্থ যা লিখা হয়েছে তা কি আমরা মেনে নিতে পারি? এক কথায় বলা যেতে পারে, না। কারণ অভিধানে মুসলিম শব্দের অর্থ যা লিখা হয়েছে তা সঠিক নয়। অর্থাৎ বাংলা ভাষার অভিধানগুলো আমাদেরকে ভুল শিক্ষা দিয়ে এসেছে এবং এখনো তা অব্যাহত আছে। তবে বাংলা একাডেমির অভিধানের বিশেষণ-এ ১. ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী ও ২. ইসলাম ধর্ম বা মুসলমান সম্পর্কিত মুদ্রিত হয়েছে। কিন্তু বিশেষ্যতে যা মুদ্রিত হয়েছে তাতে করে আর বিশেষণে মুদ্রিত অর্থের মূল্য থাকে না। কারণ বিশেষ্যতে বলা হয়েছে “হজরত মুহম্মদ সা. কর্তৃক প্রবর্তিত ইসলাম”। এখানে যে ভুলটা করেছে তার ফলে কিছুটা শুদ্ধ লেখার চেষ্টা লক্ষ করা গেলেও তাও তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ধর্ম শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক প্রবর্তিত নয়।
মুসলিম বা মুসলমান একই সমার্থক শব্দ। মুসলিম আরবি শব্দ আর মুসলমান ফার্সি শব্দ। মুসলিম বা মুসলমান শব্দের একই অর্থ প্রকাশ করে।

প্রকৃত পক্ষে মুসলিম শব্দের অর্থ কী?
মুসলিম শব্দের অর্থ (আরবি : مسلم) আত্বসমর্পণ, অনুগত বা একমাত্র আল্লাহ্র বন্দেগী ও আনুগত্যকারী। মুসলিম শব্দ অর্থ আরো খোলামেলা ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, সেই লোক যে নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহ্র কাছে আত্বসমর্পণ করে।
অতএব যে নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহ্ তা’আলার কাছে আত্বসমর্পণ করে শান্তি অর্জন করেছে তাকে মুসলিম বলে। যেমন : হযরত ইববাহীম আ.-কে যখন তার পালনকর্তা বলেন আত্মসমর্পণ কর। সে বলল আমি বিশ্ব জগতের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম। আল্লাহ্ তা’আলা কুরআন করিমের সুরা আল বাক্বারাহ্-এর ১৩১ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন এভাবে, “মুসলিম (অনুগত) হয়ে যাও, “তখনই সে বললো, “আমি বিশ্ব-জাহানের প্রভুর ‘মুসলিম’, (অনুগত) হয়ে গেলাম।”
পারিভাষিক অর্থে যদি বলি, যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনকে মহান প্রতিপালক হিসেবে গ্রহণ করবে, আল্লাহ্র সাথে কাউকে শরীক করবে না এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশিত পথে নিজের জীবন চালাবে, হালালকে হালাল বলে মানবে এবং হারামকে হারাম হিসেবে পরিত্যাগ করবে, সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, রোজা রাখবে, নিসাবের অধিকারী হলে যাকাত আদায় করবে এবং হজ্জে গমন করবে। এইসব গুণাবলীর অধিকারী হলে তাকে ‘মুসলিম’ বলা হয়।
কুরআন করিমের সূরা আন নামল-এর ৩১ নম্বর আয়াতে এরশাদ করা হয়েছে এভাবে, “আমার অবাধ্য হয়ো না এবং মুসলিম হয়ে আমার কাছে হাজির হয়ে যাও।”
হযরত সুলায়মান আ.-এর জামানায় প্রতিবেশি সাবা রাণীকে লেখা একটি চিঠি প্রসঙ্গে রাব্বুল আলামিন এই আয়াত নাযিল করেছেন। হযরত সুলায়মান আ.কে আল্লাহ্ অর্থ-সম্পদ, রাষ্ট্র-ক্ষমতা, পরাক্রম, মর্যাদা ও গৌরব এতোবেশি দান করেছিলেন যে, মক্কার কাফেররা তা কল্পনাও করতে পারতো না। কিন্তু এতোসব সত্ত্বেও তিনি আল্লাহ্র সামনে নিজেকে জবাবদিহি করতে হবে বলে মনে করতেন এবং তাঁর মধ্যে এ অনুভূতিও ছিলো যে, তিনি যা কিছুই লাভ করেছেন সবই আল্লাহ্র দান, তাই তাঁর মাথা সবসময় প্রকৃত নিয়ামত দানকারীর সামনে নত হয়ে থাকতো এবং আত্ম-অহমিকার গন্ধও তাঁর চরিত্র ও কার্যকলাপে পাওয়া যেতো না।
অপর দিকে সাবার রাণী ছিলেন আরবের ইতিহাসের বিপুল খ্যাতিমান ধনাঢ্য জাতির শাসক। কোনো মানুষকে অহংকারে মদমত্ত করার জন্য যেসব উপকরণের প্রয়োজন তা সবই তার ছিলো। যেসব জিনিসের জোরে কোনো মানুষ আত্মম্ভরী হতে পারে তা কুরাইশ নেতাদের তুলনায় হাজার লক্ষ গুণ বেশি তাঁর আয়ত্তাধীন ছিলো। তাছাড়া তিনি ছিলেন একটি মুশরিক জাতির অন্তরভুক্ত। পিতৃপুরুষের অনুসরণের জন্যও এবং জাতির মধ্যে নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রাখার উদ্দেশ্যেও তাঁর পক্ষে শিরক ত্যাগ করে তওহিদের পথ অবলম্বন করা সাধারণ একজন মুশরিকের জন্য যতোটা কঠিন হতে পারে তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ছিলো। কিন্তু যখনই তাঁর সামনে সত্য সুস্পষ্ট হয়ে গেছে তখনই তিনি সত্যকে গ্রহণ করতে একটুও দ্বিধান্বিত হন নি। এ পথে কেউ বাধা দিয়ে তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে নি। কারণ তাঁর মধ্যে যে ভ্রষ্টতা ও বিভ্রান্তি ছিলো নিছক একটি মুশরিকি পরিবেশে চোখ মেলার ফলেই তা সৃষ্টি হয়েছিলো। প্রবৃত্তির উপাসনা ও কামনার দাসত্ব করার রোগ তাঁকে পেয়ে বসে নি। তাঁর বিবেক আল্লাহ্র সামনে জবাবদিহির অনুভূতিশূন্য ছিলো না।
সাবার রাণী যেহেতু মুশরিক ছিলেন সে কারণে হযরত সুলায়মান আ. তাকে তাঁর মুশরিকি আমল ছেড়ে দিয়ে মুসলিম তথা আল্লাহ্র একনিষ্ট বান্দা হওয়ার আহবান জানিয়ে পত্র দেওয়ার পরে তাঁর মধ্যে চেতনা ফিরে আসে। তিনি বুঝতে পারেন তিনি ভ্রষ্টতার মধ্যেই আছেন। ফলে তিনি তাঁর পূর্ববর্তী জীবনের কদাকার রীতি-নীতি, সংস্কৃতি, ধর্মকে বাক্স বন্দি করে হযরত সুলায়মান আ.-এর আহবানে আল্লাহ্র দীন (দীন ইসলাম) গ্রহণ করেন এবং মুসলিম হন।

মুসলিম কারা
প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, পৃথিবীতে মুসলিম বা মুসলমান বলতে কারা? ভূমিকাতে আলোচনার সূচনা করেছি যে, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মতেরাই কী শুধুমাত্র মুসলিম? উত্তরে স্পষ্ট করে বলতে হয় যে, শেষ নবীর উম্মতেরাই শুধু মুসলিম নয়। আদি পিতা হযরত আদম আ. ও মা হাওয়া আ. মুসলিম ছিলেন। আল্লাহ তা’আলা পৃথিবীতে যত নবী, রাসুল, পয়গাম্বর পাঠিয়েছেন তারা সবাই মুসলিম ছিলেন। তাদের উম্মতেরা মুসলিম ছিলেন। রাব্বুল আলামিন কুরআন করিমের একাধিক স্থানে মুসলিমের সংজ্ঞা নিয়ে এরশাদ করেছেন।
আমাদের জেনে রাখা দরকার যে, মুসলিম কোন পারিবারিক উপাধি নয়। বংশানুক্রমে মুসলমান পরিবারে জন্ম হলে, খতনা হলে, আর আরবি নাম রাখলেই কেউ মুসলমান হয় না। মুসলমানিত্ব এমন কোন বিষয় নয় যে, আমি মানি বা না মানি তা আমার সাথে লেপ্টে থাকবে। মুসলমানিত্ব ধারণ ও লালন-পালনের বিষয়।
যে ব্যক্তি আল্লাহ্র অনুগত হয়, আল্লাহ্কে নিজের মালিক, প্রভু ও মা’বুদ হিসেবে মেনে নেয়, নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহ্র হাতে সোপর্দ করে দেয় এবং দুনিয়ায় আল্লাহ্ প্রদত্ত জীবন বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করে সে-ই মুসলিম। এ আকীদা- বিশ্বাস ও কর্মপদ্ধতির নাম ‘ইসলাম’ মানব জাতির সৃষ্টিলগ্ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে দুনিয়ার মধ্যে যে সকল নবী-রসূল এসেছেন এটিই ছিলো তাঁদের সবার দীন ও জীবন বিধান।
কোন ব্যক্তি যদি মুসলিম হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে তাকে সর্বপ্রথম সমস্ত সৃষ্ট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সমস্ত কিছুর স্রষ্টা মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের দিকে মুখ ফিরাতে হবে। যেমনÑ আল্লাহ্ তা’আলা কুরআন করিমের সূরা আল আন‘আম-এর ৭৯ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন এভাবে, “আমি তো একনিষ্ঠভাবে নিজের মুখ সেই সত্তার দিকে ফিরিয়ে নিয়েছি যিনি যমীন ও আকাশসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং আমি কখনো মুশরিকদের অন্তরভুক্ত নই।”
এছাড়াও রাব্বুল আলামিন সুনির্দিষ্টভাবে কুরআন কারিমের সূরা আল বাক্বারাহ’র ১৩১ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন এভাবে, “তার অবস্থা এই ছিলো যে, তার রব যখন তাকে বললো, “মুসলিম (অনুগত) হয়ে যাও, “তখনই সে বললো, “আমি বিশ্ব-জাহানের প্রভুর ‘মুসলিম’, (অনুগত) হয়ে গেলাম।”
অন্যত্র সূরা আলে ইমরান-এর ৬৪ নম্বর আয়াতে রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেছেন এভাবে, “হে আহলি কিতাব! এসো এমন একটি কথার দিকে, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই ধরনের। তা হচ্ছে : আমরা আল্লাহ্ ছাড়া কারোর বন্দেগী ও দাসত্ব করবো না। তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবো না। আর আমাদের কেউ আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকেও নিজের রব হিসেবে গ্রহণ করবো না। যদি তারা এ দাওয়াত গ্রহণ করতে প্রস্তুত না হয়, তাহলে পরিষ্কার বলে দাও : তোমরা সাক্ষী থাকো, আমরা অবশ্যই মুসলিম (একমাত্র আল্লাহ্র বন্দেগী ও আনুগত্যকারী)।”
সূরা আল বাক্বারাহ’র ১৪০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুবহানু তা’আলা এরশাদ করেছেন এভাবে,
“অথবা তোমরা কি একথা বলতে চাও যে, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়া’কূব ও ইয়া’কূব – সন্তানরা সবাই ইহুদি বা খৃষ্টান ছিলো?” বলো, “তোমরা বেশি জানো, না আল্লাহ?” যার যিম্মায় আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সাক্ষ্য বিদ্যমান রয়েছে এবং সে তা গোপন রাখে তার চেয়ে বড়ো জালেম আর কে হতে পারে? তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে আল্লাহ উদাসীন নন।”
এ প্রসঙ্গে বলা যায়, যেসব মূর্খ ইহুদি ও খৃস্টান জনতা যথার্থই মনে করতো, এ বড়ো বড়ো মহান নবীদের সকলেই ইহুদি বা খৃস্টান ছিলেন, তাদেরকে সম্বোধন করে ওপরের আয়াতটি নাযিল করা হয়েছে।
এখানে ইহুদি ও খৃস্টান আলেমদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। তারা নিজেরাও এ সত্যটি জানতো যে, ইহুদিবাদ ও খৃস্টবাদ সে সময় যে বৈশিষ্ট্য ও অবয়বসহ বিরাজ করছিলো তা অনেক পরবর্তীকালের সৃষ্টি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা সত্যকে একমাত্র তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করছিলো। তারা জনগণকে ভুল ধারণা দিয়ে আসছিলো যে, নবীদের অতীত হয়ে যাবার দীর্ঘকাল পর তাদের ফকীহ, ন্যায়শাস্ত্রবিদ ও সূফীরা যে সমস্ত আকীদা- বিশ্বাস, পদ্ধতি, রীতি-নীতি ও ইজতিহাদী নিয়ম- কানুন রচনা করেছে, সেগুলোর অনুসরণের মধ্যেই মানুষের কল্যাণ ও মুক্তি নিহিত রয়েছে। সংশ্লিষ্ট আলেমদেরকে জিজ্ঞেস করা হতো, তোমাদের একথাই যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে হযরত ইবরাহীম, ইসহাক, ইয়া’কূব আ. প্রমুখ নবীগণ তোমাদের এ সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে কোন সম্প্রদায়ের অন্তরভুক্ত ছিলেন? তারা এর জবাব এড়িয়ে যেতো। কারণ ঐ নবীগণ তাদের সম্প্রদায়ের অন্তরভুক্ত ছিলেন – নিজেদের জ্ঞান অনুযায়ী তারা একথা দাবি করতে পারতো না। কিন্তু নবীগণ ইহুদিও ছিলেন না এবং খৃস্টানও ছিলেন না, একথা যদি তারা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিতো তাহলে তো তাদের সব যুক্তিই শেষ হয়ে যেতো।
এ কারনেই কুরআন করিমের সূরা আলে ইমরান-এর ৬৭ নম্বর আয়াতে রাব্বুল আলামিন স্পষ্ট করে এরশাদ করেছেন এভাবে, “ইবরাহীম ইহুদী ছিল না, খৃষ্টানও ছিল না বরং সে তো ছিল একজন একনিষ্ঠ মুসলিম এবং সে কখনো মুশরিকদের অন্তরভুক্ত ছিল না।”
উপরের আলোচনা থেকে মুসলিম কারা এব্যাপারে আমরা স্পষ্ট একটি ধারণা পাই। আর সেই ধারণা হচ্ছে একমাত্র আল্লাহ্র বন্দেগী ও আনুগত্যকারীরাই হচ্ছে মুসলিম।

ইসলামের অনুসারীদের নাম আল্লাহ্ মুসলিম রেখেছেন
প্রশ্ন আসতে পারে ইসলাম কী, ইসলামের অনুসারী কারা? বাংলা ভাষায় প্রচলিত অভিধান অনুযায়ী শেষ নবী হজরত মুহম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্মই কী ‘ইসলাম’? প্রকৃত অর্থে শেষ নবী হজরত মুহম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্ম ‘ইসলাম’ নয়। আদি পিতা হযরত আদম আ. ও আদি মাতা হাওয়া আ.-এর ধর্ম ছিলো ইসলাম। অর্থাৎ আল্লাহ্র ‘দীন’টাই হচ্ছে ইসলাম।
ইসলাম হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। আরবি ‘দীন’ শব্দের অর্থ জীবন পদ্ধতি ও জীবনবিধান। মানুষ দুনিয়ায় যে আইন ও নীতিমালার ভিত্তিতে তার সমগ্র চিন্তা, দর্শন ও কর্মনীতি গড়ে তোলে তাকে বলা হয় ‘দীন’। যারা আল্লাহ্র বেধে দেওয়া জীবন পদ্ধতি ও জীবনবিধান মেনে চলে তারাই ইসলামের অনুসারী। এই ‘দীন’ তথা ইসলামের অনুসারীরাই ‘মুসলিম’।
এ প্রসঙ্গে রাব্বুল আলামীন কুরআন করিমের সূরা আল বাক্বারাহ’র ১৩২ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন এভাবে,
“ঐ একই তরীকায় (পথে) চলার জন্য সে তার সন্তানদের উপদেশ দিয়েছিলো এবং একই উপদেশ দিয়েছিলো ইয়া‘কূবও তার সন্তানদেরকে। সে বলেছিলো, “আমার সন্তানেরা! আল্লাহ্ তোমাদের জন্য এ ‘দীন’টিই পছন্দ করেছেন। কাজেই মৃত্যুর শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমরা মুসলিম থেকো।”
এখানে আমরা জানার চেষ্টা করি ইসলামের অনুসারী কারা? ইসলামকে ইবরাহীমের মিল্লাতের ন্যায়, নূহের মিল্লাত, মুসার মিল্লাত ও ঈসার মিল্লাত বলা যেতে পারে কিন্তু কুরআন করিম বার বার একে ইবরাহীমের মিল্লাত বলেছে। একই সাথে ইবরাহীমের তরীকার অনুসারী হওয়ার দাওয়াত দেয়া হয়েছে তিনটি কারণে। বিশেষ করে, এক. কুরআন করিমের বক্তব্যের প্রথম লক্ষ ছিলো আরবি ভাষাভাষী আরববাসী। আর তারা ইবরাহীমের সাথে যেভাবে পরিচিত ছিলো তেমনটি আর কারো সাথে ছিল না। তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আকীদা-বিশ্বাস যার ব্যক্তিত্বের প্রভাব সর্বব্যাপী ছিল তিনি ছিলেন হযরত ইবরাহীম আ.। দুই. হযরত ইবরাহীমই এমন ব্যক্তি ছিলেন যার উন্নত চরিত্রের ব্যাপারে ইহুদী, খৃষ্টান, মুসলমান, আরবীয় মুশরিক ও মধ্যপ্রাচ্যের সাবেয়ী তথা নক্ষত্র পূজারীরা সবাই একমত ছিল। নবীদের মধ্যে দ্বিতীয় এমন কেউ ছিলেন না এবং নেই যার ব্যাপারে সবাই একমত হতে পারে। তিন. হযরত ইবরাহীম এসব মিল্লাতের জন্মের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছেন। ইহুদীবাদ, খৃষ্টবাদ ও সাবেয়ীবাদ সম্পর্কে তো সবাই জানে যে, এগুলো পরবর্তীকালে উদ্ভাবিত হয়েছে আর আরবিয় মুশরিকদের ব্যাপারে বলা যায়, তারা নিজেরাও একথা স্বীকার করতো যে, তাদের সমাজে মূর্তিপূজা শুরু হয় আমর ইবনে লুহাই থেকে। সে ছিল বনি কুযা’আর সরদার। মা’আব (মাওয়াব) এলাকা থেকে সে ‘হুবুল’ নামক মূর্তি নিয়ে এসেছিল। তার সময়টা ছিলো বড় জোর হযরত ঈসা আ.-এর পাঁচ থেকে ছ’শ বছর আগের। কাজেই এ মিল্লাতটিও হযরত ইবরাহীমের শত শত বছর পরে তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় কুরআন করিম যখন বলে এ মিল্লাতগুলোর পরিবর্তে ইবরাহীমের মিল্লাত গ্রহণ করো তখন সে আসলে এ সত্যটি জানিয়ে দেয় যে, যদি হযরত ইবরাহীম সত্য ও হিদায়তের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে থাকেন এবং মিল্লাতগুলোর মধ্য থেকে কোনোটিরই অনুসারী না থেকে থাকেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই তাঁর মিল্লাতই প্রকৃত সত্য মিল্লাত। পরবর্তীকালের মিল্লাতগুলো সত্য নয়। আর হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মিল্লাতের দিকেই দাওয়াত দিচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে কুরআন করিমের সূরা আল বাক্বারাহ্-এর ১৩৫ নম্বর আয়াতে রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেছেন এভাবে, “ইহুদীরা বলে, “ইহুদী হয়ে যাও, তাহলে সঠিক পথ পেয়ে যাবে।” “খৃষ্টানরা বলে, খৃষ্টান হয়ে যাও, তাহলে হেদায়াত লাভ করতে পারবে।” ওদেরকে বলে দাও, “না, বরং এসব কিছু ছেড়ে দিয়ে একমাত্র ইবরাহীমের তরীকা (পথ বা নীতি) অবলম্বন করো। আর ইবরাহীম মুশরিকদের অন্তরভুক্ত ছিলো না।”
রাব্বুল আলামিন কুরআন করিমের সূরা আল হাজ্জ-এর ৭৮ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন এভাবে, “আল্লাহর পথে জিহাদ করো যেমন জিহাদ করলে তার হক আদায় হয়। তিনি নিজের কাজের জন্য তোমাদেরকে বাছাই করে নিয়েছেন এবং দীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো সংকীর্ণতা আরোপ করেন নি। তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও। আল্লাহ্ আগেও তোমাদের নাম রেখেছিলেন “মুসলিম” এবং এর (কুরআন) মধ্যেও (তোমাদের নাম এটিই) যাতে রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হন এবং তোমরা সাক্ষী হও লোকদের ওপর। কাজেই নামায কায়েম করো, যাকাত দাও এবং আল্লাহ্র সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাও। তিনি তোমাদের অভিভাবক, বড়ই ভালো অভিভাবক তিনি, বড়ই ভালো সাহায্যকারী তিনি।”
মানব ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই যারা তাওহিদ, আখেরাত, রিসালাত ও আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী দলভুক্ত থেকেছে তাদের সবাইকেই উপরের আয়াতে সম্বোধন করা হয়েছে। এখানে মূল বক্তব্য হচ্ছে, এ সত্য মিল্লাতের অনুসারীদেরকে কোনোদিন “নূহী”, “ইবরাহিমী”, “মূসাভী” বা “মসীহী” ইত্যাদি বলা হয় নি বরং তাদের নাম “মুসলিম” (আল্লাহর ফরমানের অনুগত) ছিল এবং আজো তারা “মুহাম্মদী” নয় বরং মুসলিম। একথাটি না বুঝার কারণে লোকদের জন্য এ প্রশ্নটি একটি ধাঁধার সৃষ্টি করে রেখেছে যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসারীদেরকে কুরআন করিমের পূর্বে কোন্ কিতাবে মুসলিম নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো?
সূরা আল বাকারাহ’র ১২৮ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন এভাবে, “হে প্রভু! আমাদের দু’জনকে তোমার মুসলিম (নির্দেশের অনুগত) বানিয়ে দাও। আমাদের বংশ থেকে এমন একটি জাতির উত্থান করো যে হবে তোমার মুসলিম (অনুগত)। তোমার ইবাদতের পদ্ধতি আমাদের বলে দাও এবং আমাদের ভুলচুক মাফ করে দাও। তুমি ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী।”

সকল নবীর অনুসারীর নাম ছিল মুসলিম
রাব্বুল আলামিন কুরআন করিমের সূরা আল হাজ্জ-এর ৭৮ নম্বর আয়াতে স্পষ্ট করে বলেছেন, “…. তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও। আল্লাহ্ আগেও তোমাদের নাম রেখেছিলেন “মুসলিম” এবং এর (কুরআন) মধ্যেও (তোমাদের নাম এটিই) যাতে রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হন এবং তোমরা সাক্ষী হও লোকদের ওপর।”
মানব ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই যারা তাওহিদ, আখেরাত, রিসালাত ও আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী দলভুক্ত থেকেছে তাদের সবাইকেই উপরের আয়াতে সম্বোধন করা হয়েছে ‘মুসলিম’ হিসেবে। এখানে মূল বক্তব্য হচ্ছে, এ সত্য মিল্লাতের অনুসারীদেরকে কোনোদিন “নূহী”, “ইবরাহিমী”, “মূসাভী” বা “মসীহী” ইত্যাদি বলা হয় নি বরং তাদের নাম “মুসলিম” (আল্লাহর ফরমানের অনুগত) ছিল এবং আজো তারা “মুহাম্মদী” নয় বরং মুসলিম।
কুরআন করিমের সুরা কাসাস-এর ৫৩ নম্বর আয়াতে রাব্বুল আলামিন ‘মুসলিম’ সম্পর্কে আরো স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। কুরআন করিমের ৫৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানু তা’আলা এরশাদ করেছেন এভাবে, “আর যখন তাদেরকে এটা শুনানো হয় তখন তারা বলে, “আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, এটি যথার্থই সত্য আমাদের রবের পক্ষ থেকে, আমরা তো আগে থেকেই মুসলিম।”
সুরা কাসাস-এর বক্তব্য অনুযায়ী আগেও আমরা নবীদের ও আসমানী কিতাবের আনুগত্য করে এসেছি। তাই ইসলাম ছাড়া আমাদের জন্য কোনো দীন ছিলো না। আর এখন যে নবী আল্লাহ্র পক্ষ থেকে কিতাব এনেছেন তাকেও আমরা মেনে নিয়েছি। কাজেই মূলত আমাদের দীনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং আগেও যেমন আমরা ‘মুসলিম’ ছিলাম তেমনি এখনও ‘মুসলিম’ আছি।
একথা থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দীনের দাওয়াত দিয়েছেন তার নামই ইসলাম নয় এবং ‘মুসলিম’ পরিভাষাটি শুধুমাত্র নবী করীম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসারীগণ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। বরং সব সময় এ ইসলামই ছিলো সকল নবীর দীন এবং সব জমানায় তাঁদের সবার অনুসারীগণ মুসলমানই ছিলেন। এ মুসলমানরা যদি কখনো পরবর্তীকালে আগত কোনো সত্য নবীকে মানতে অস্বীকার করে থাকে তাহলে কেবল তখনই তারা কাফের হয়ে গিয়ে থাকবে। কিন্তু যারা পূর্বের নবীকে মানতো এবং পরে আগত নবীকেও মেনে নিয়েছে তাদের ইসলামে কোনো ছেদ পড়ে নি। তারা পূর্বেও যেমন মুসলমান ছিলো, পরেও তেমনি মুসলমান থেকেছে।
আশ্চর্য, প্রবীন জ্ঞানীগুণী আলেমদের মধ্যেও কেউ কেউ এ সত্যটি অনুধাবন করতে অক্ষম হয়েছেন, এমনকি এ সুষ্পষ্ট আয়াতটি দেখেও তাঁরা নিশ্চিন্ত হন নি। আল্লামা সুয়ুতী ‘মুসলিম’ পরিভাষাটি কেবলমাত্র হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মতের সাথেই বিশেষভাবে সম্পৃক্ত এ মর্মে বিস্তারিত আলোচনা সম্বলিত একটি বই লিখেছেন। তারপর যখন এ আয়াতটি সামনে এসেছে তখন নিজেই বলেছেন, “এখন তো আমার আক্কেল গুড়–ম হয়ে গেছে।” কিন্তু এরপর বলছেন, “আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম যে, এ ব্যাপারে আমার হৃদয় প্রসারিত করে দাও।” শেষে নিজের অভিমত প্রত্যাহার করার পরিবর্তে তিনি তার ওপরই জোর দিয়েছেন এবং এ আয়াতটির কয়েকটি ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। এ ব্যাখ্যাগুলোর একটি অন্যটির চেয়ে বেশী ওজনহীন। যেমন, তাঁর একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, “আমরা কুরআন করিম আসার আগেই মুসলিম হয়ে যাবার সংকল্প পোষণ করতাম। কারণ আমাদের কিতাবসমূহ থেকে আমরা তাঁর আসার খবর পেয়ে গিয়েছিলাম এবং আমাদের সংকল্প ছিলো, তিনি আসলেই আমরা ইসলাম গ্রহণ করে নেবো। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হচ্ছে, “অর্থ্যাৎ আগে থেকেই আমরা কুরআন করিম মানতাম। কারণ আমরা তাঁর আগমনের আশা পোষণ করতাম এবং পূর্বাহ্নেই তাঁর নাযিল হবার পূর্বে যথার্থ সত্য বলে মেনে নেবার জন্যই আমরা মুসলিম ছিলাম। তৃতীয় ব্যাখ্যা হচ্ছে, আল্লাহর তাকদীরে পূর্বেই আমাদের জন্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলাম যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরআনের আগমনে আমরা ইসলাম গ্রহণ করবো। তাই আসলে আমরা আগে থেকে মুসলিম ছিলাম। এই ব্যাখ্যাগুলোর কোনো একটি দেখেও আল্লাহ্ প্রদত্ত হৃদয়ের প্রশস্ততার কোনো প্রভাব সেখানে আছে বলে মনে হচ্ছে না।
প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, কুরআন করিম কেবলমাত্র এই একটি স্থানেই নয়, বরং অসংখ্য জায়গায় এ সত্যটি বর্ণনা করেছে। কুরআন করিম বলছে, আসল দীন হচ্ছে একমাত্র ‘ইসলাম’ (আল্লাহর আনুগত্য) এবং আল্লাহর বিশ্ব-জাহানে আল্লাহর সৃষ্টির জন্য এছাড়া দ্বিতীয় কোনো দীন বা ধর্ম হতে পারে না। সৃৃষ্টির প্রথম দিন থেকে যে নবীই মানুষকে পথনির্দেশ দেবার জন্য এসেছেন তিনি এ দীন নিয়েই এসেছেন। আর নবীগণ হামেশাই নিজেরা মুসলিম থেকেছেন, নিজেদের অনুসারীদেরকে মুসলিম হয়ে থাকার তাকিদ দিয়েছেন এবং তাঁদের যেসব অনুসারী নবুওয়াতের মাধ্যমে আগত আল্লাহ্র ফরমানের সামনে আনুগত্যের শির নত করে দিয়েছেন তারাও প্রতিটি যুগে মুসলিমই ছিলেন। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্তস্বরূপ শুধুমাত্র গুটিকয় আয়াত এখানে উপস্থাপন করলাম।
“আসলে আল্লাহ্র কাছে ইসলামই একমাত্র দীন।” (সূরা আলে ইমরান : ১৯)
“আর যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন অবলম্বন করে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না।”
হযরত নূহ আ. বলেন,
“তোমরা আমার উপদশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছো (এতে আমার কী ক্ষতি করেছো), আমি তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই নি। আমার প্রতিদান তো আল্লাহ্র কাছে। আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছে (কেই স্বীকার করুক বা না করুক) আমি যেনো মুসলিম হিসেবে থাকি।” (সূরা ইউনুস : ৭২)।
হযরত ইবরাহীম আ. এবং তাঁর সন্তানদের সম্পর্কে বলা হয় :
“যখন তার রব তাকে বললেন, মুসলিম (ফরমানের অনুগত) হয়ে যাও, সে বললো, আমি মুসলিম হয়ে গেলাম রাব্বুল আলামীনের জন্য। আর এ জিনিসটিরই ওসিয়াত করে ইবরাহীম তার সন্তানদেরকে এবং ইয়া‘কুবও : হে আমার সন্তানরা! আল্লাহ্ তোমাদের জন্য এ দীনটিই পছন্দ করেছেন। কাজেই মুসলিম না হয়ে তোমরা কখনো মৃত্যুবরণ করো না। তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে যখন ইয়া‘কুবের মৃত্যুর সময় এসে গিয়েছিলো, যখন সে তার পুত্রদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলো, “আমার মৃত্যুর পর তোমরা কার ইবাদত করবে?” তারা জবাব দিয়েছিল, “আমরা ইবাদত করবো আপনার ইলাহ-এর এবং আপনার বাপ দাদা ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের ইলাহ-এর তাঁকে একক ইলাহ হিসেবে মেনে নিয়ে। আর আমরা তাঁরই অনুগত- মুসলিম।” (সূরা আল বাকারাহ : ১৩১-১৩৩)
“ইবরাহীম ইহুদী ছিলো না, খৃষ্টানও ছিলো না, বরং ছিলো একনিষ্ঠ মুসলিম।” (সূরা আলে ইমরান : ৬৭)।
স্বয়ং হযরত ইবরাহীম আ. ও ইসমাঈল আ. দোয়া করেন :
“হে আমাদের রব। আমাদেরকে তোমার মুসলিম (অনুগত) করো এবং আমাদের বংশ থেকে একটি উম্মত সৃষ্টি করো যে হবে তোমার মুসলিম।” (সূরা আল বাকারাহ : ১২৮)।
হযরত লূতের কাহিনীতে বলা হচ্ছে :
“আমরা লূতের জনপদের একটি বাড়ি ছাড়া মুসলমানদের আর কোনো বাড়ি পাইনি।” (সূরা আয যারিয়াত : ৩৬)।
হযরত ইউসুফ আ. মহিমান্বিত রবের দরবারে নিবেদন করেন :
“হে আমার রব! তুমি আমাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছো এবং আমাকে কথার গভীরে প্রবেশ করা শিখিয়েছো। হে আকাশ ও পৃথিবীর ¯্রষ্টা! দুনিয়ায় ও আখেরাতে তুমিই আমার অভিভাবক। ইসলামের ওপর আমাকে মৃত্যু দান করো এবং পরিণামে আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের (মুসলিম) অন্তরভুক্ত করো।” (সূরা ইউসুফ : ১০১)।
হযরত মূসা আ. তাঁর নিজের জাতিকে বলেন :
“মুসা তার কওমকে বললো, “হে লোকেরা! যদি তোমরা সত্যি আল্লাহ্র প্রতি ঈমান এনে থাকো, তাহলে তাঁর ওপরই ভরসা করো, যদি তোমরা আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) হও।” (সূরা ইউনুস : ৮৪)।
বনী ইসরাঈলের আসল ধর্ম ইহুদীবাদ নয় বরং ইসলাম ছিলো। বন্ধু ও শত্রু সবাই একথা জানতো। কাজেই ফেরাউন সাগরে ডুবে যেতে যেতে যে শেষ কথাটি বলে তা হচ্ছে :
“আর আমি বনী ইসরাঈলকে সাগর পার করে নিয়ে গেলাম। আর ফেরাউন ও তার সেনাদল যুলুম-নির্যাতন ও সীমালংঘন করার উদ্দেশ্যে তাদের পেছনে চললো। অবশেষে যখন ফেরাউন ডুবতে থাকলো তখন বলে উঠলো, “আমি ঈমান আনলাম, বনী ইসরাঈল যার প্রতি ঈমান এনেছে তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই এবং আমিও আনুগত্যের (মুসলিম) শির নতকারীদের অন্তরভুক্ত।” (সূরা ইউনুস : ৯০)।
বনী ইসরাঈলের সকল নবীর দীনও ছিলো এ ইসলাম :
“আমি তাওবাত নাযিল করেছি, যাতে ছিলো হেদায়াত ও আলো, সে অনুযায়ী সে নবীগণ যারা মুসলিম ছিল তাদের বিষয়াদির ফায়সালা করতো যারা ইহুদি হয়ে গিয়েছিলো।” (সূরা আল মায়েদাহ : ৪৪)।
এটিই ছিলো হযরত সুলায়মান আ. এর দীন। সেজন্য সাবার রাণী তাঁর প্রতি ঈমান আনতে গিয়ে বলছেন :
“আমি সুলায়মানের সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি অনুগত হয়ে গেলাম।” (সূরা আন নামল : ৪২)।
আর এটিই ছিল হযরত ঈসা আ. ও তাঁর হাওয়ারিদের (সহযোগী) দীন :
“আর যখন আমি হাওয়ারিদের কাছে ওহী পাঠালাম যে, ঈমান আনো আমার প্রতি এবং আমার রসূলের প্রতি, তখন তারা বললো, আমরা ঈমান এনেছি এবং সাক্ষী থাকো আমরা মুসলিম।” (সূরা আল মায়েদাহ : ১১১)
যদি সন্দেহ পোষণ করা হয় যে, আরবি ভাষার ‘ইসলাম’ ও ‘মুসলিম’ শব্দ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন ভাষায় কেমন করে ব্যবহৃত হতে পারতো, তাহলে বলতে হয় যে, এটা নিছক একটা অজ্ঞতাপ্রসূত কথা। কারণ এ আরবি শব্দগুলো আসল বিবেচ্য নয়, আরবি ভাষায় এ শব্দগুলো যে অর্থে ব্যবহৃত হয় সেটিই মূল বিবেচ্য বিষয়। আসলে এ আয়াতগুলোতে যে কথাটি বলা হয়েছে তা হচ্ছে, আল্লাহ্র পক্ষ থেকে যে প্রকৃত দীনটি এসেছে তা খৃষ্টবাদ, মূসাবাদ ও মুহাম্মদবাদ নয় বরং তা হচ্ছে নবীগণ ও আসমানী কিতাবসমূহের মাধ্যমে আগত আল্লাহ্র ফরমানের সামনে আনুগত্যের শির নত করে দেয়া এবং এ নীতি আল্লাহ্র যে বান্দা যেখানেই যে যুগেই অবলম্বন করেছে সে-ই হয়েছে একই বিশ্বজনীন, আদি ও চিরন্তন সত্যদীনের অনুসারী। যারা এ দীনকে যথার্থ সচেতনতা ও আন্তরিকতা সহকারে গ্রহণ করেছে তাদের জন্য মুসার পরে ঈসাকে এবং ঈসার পরে হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে মেনে নেয়া ধর্ম পরিবর্তন করা হবে না, বরং হবে প্রকৃত ও আসল ধর্মের অনুসরণ করার স্বাভাবিক ও ন্যায়সংগত দাবি। পক্ষান্তরে যারা আম্বিয়া আ.-এর উম্মতের মধ্যে না জেনে- বুঝে ঢুকে পড়েছে অথবা তাঁদের দলে জন্ম নিয়েছে এবং জাতীয় ও বংশীয় স্বার্থপ্রীতি যাদের জন্য আসল ধর্মে পরিণত হয়ে গেছে তারা ইহুদি ও খৃষ্টান হয়ে রয়ে গেছে এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগমনে তাদের মুর্খতা ও অজ্ঞতার হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে গেছে। কারণ তারা আল্লাহ্র শেষ নবীকে অস্বীকার করেছে। আর এটা করে তারা শুধু যে নিজেদের ভবিষ্যতে মুসলিম হয়ে থাকাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তাই নয়, বরং নিজেদের এ কার্যকলাপের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা আসলে ইতিপূর্বেও “মুসলিম” ছিলো না, নিছক একজন নবীর বা কয়েকজন নবীর ব্যক্তিত্বের ভক্ত ও অনুরক্ত ছিল। অথবা পিতা-প্রপিতার অন্ধ অনুকরণকে ধর্মীয় আচারে পরিণত করে রেখেছিলো।
সুরা আল কাসাস-এর ৫৩ নম্বর আয়াতের মর্মার্থ অনুযায়ী ৫২ নম্বর আয়াতের দিকে আমরা লক্ষ করলে বুঝতে পারি যারা আল্লাহ্র একনিষ্ট বান্দা ছিলো, যারা আল্লাহ্র দীনকে একান্তভাবে নিজেদের করে নিয়েছিলো তারা পরবর্তীতে আল্লাহ্ তা’আলার দীনকে নিজেদের করে নিয়েছে। আয়াতের দিকে লক্ষ করুন, আল্লাহ্ তা’আলা এখানে এরশাদ করেছেন এভাবে,
“যাদেরকে আমি এর আগে কিতাব দিয়েছিলাম তারা এর (কুরআন) প্রতি ঈমান আনে।”
এ প্রসঙ্গে ইবনে হিশাম, বায়হাকী প্রমুখ এ ঘটনাকে মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের বরাত দিয়ে নি¤েœাক্তভাবে বর্ণনা করেছেন, আবিসিনিয়ায় হিজরতের পর নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নবুওয়াত প্রাপ্তি এবং তাঁর দাওয়াতের খবর যখন সেই দেশে ছড়িয়ে পড়লো তখন সেখান থেকে প্রায় ২০ জনের একটি খ্রিষ্টান প্রতিনিধিদল প্রকৃৃত অবস্থা অনুসন্ধানের জন্য মক্কা মু’আয্যমায় এলো। তারা নবী সা. এর সাথে মসজিদুল হারামে সাক্ষাত করলো। কুরাইশদের বহু লোকও বিষয়টি জানতে পেরে আশপাশে দাঁড়িয়ে গেলো। প্রতিনিধিদলের লোকেরা নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে কিছু প্রশ্ন করলো। তিনি সেগুলোর জবাব দিলেন। তারপর তিনি তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআন করিমের আয়াত তাদের সামনে পাঠ করলেন। কুরআন শুনে তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগলো। তারা একে আল্লাহ্র বাণী বলে অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করলো এবং নবী মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ঈমান আনলো। মজলিস শেষ হবার পর আবু জাহেল ও তার কয়েকজন সাথী প্রতিনিধিদলের লোকদেরকে পথে ধরলো এবং তাদেরকে যাচ্ছে তাই বলে তিরস্কার করলো। তাদেরকে বললো, “তোমাদের সফরটা তো বৃথাই গেলো। তোমাদের স্বধর্মীয়রা তোমাদেরকে এজন্য পাঠিয়েছিলো যে, এ ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে তোমরা যথাযথ অনুসন্ধান চালিয়ে প্রকৃত ও যথার্থ ঘটনা তাদেরকে জানাবে। কিন্তু তোমরা সবেমাত্র তার কাছে বসেছিলে আর এরই মধ্যেই নিজেদের ধর্ম ত্যাগ করে তার প্রতি ঈমান আনলে? তোমাদের চেয়ে বেশি নির্বোধ কখনো আমরা দেখি নি।”
একথায় তারা জবাব দিলো, “ভাইয়েরা তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা তোমাদের সাথে জাহিলী বিতর্ক করতে চাই না। আমাদের পথে আমাদের চলতে দাও এবং তোমরা তোমাদের পথে চলতে থাকো। আমরা জেনেবুঝে কল্যাণ থেকে নিজেদেরকে বি ত করতে পারি না” (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২ খ-, ৩২ পৃষ্ঠা এবং আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৩ খ-, ৮২ পৃষ্ঠা। আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আশ শু’আরা, ১২৩ টীকা)।
সকল নবীর অনুসারীদের নাম যে ছিল মুসলিম তা সূরা আয যারিয়াত-এর ৩৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুবহানু আ’আলা এরশাদ করেছেন এভাবে, “আমি সেখানে একটি পরিবার ছাড়া আর কোনো মুসলিম পরিবার পাই নি।”
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে, ‘মুসলমান’ কেবল হযরত মুহাম্মদ সা.-এর উম্মতের নাম নয়। তাঁর পূর্বের সমস্ত নবী-রসুলও তাঁদের উম্মতও মুসলমান ছিলেন। তাঁদের দীনও ভিন্ন ভিন্ন ছিলো না যে, কোনোটা ইবরাহীমের দীন, কোনোটা মুসার দীন আবার কোনোটা ঈসার দীন বলে আখ্যায়িত হত পারে। তাঁরা সবাই ছিলেন মুসলমান এবং তাদের দীনও ছিলো এই ইসলাম। কুরআন করিমের বিভিন্ন জায়গায় এ সত্যটি এমন সুষ্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
ঈমানদারদের আসল নাম মুসলিম
রাব্বুল আলামিন কুরআন করিমের সুরা আল হাজ্জ-এ মুসলিমদের ব্যাপারে বিস্তারিত এরশাদ করেছেন। সুরায় দ্বিধাগ্রস্ত ও দোটানায় পড়ে থাকা মুসলিমগণ এবং আপোষহীন সত্যনিষ্ঠ মুমিন সমাজের ব্যাপারে আলোচনা এসেছে।
সূরা আর হাজ্জ-এর ৭৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন এভাবে,
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা রুকু কর, সেজদা কর, তোমাদের পালনকর্তার এবাদত কর এবং সৎকাজ সম্পাদন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।”
অতএব, সূরা আল হাজ্জ-এর ৭৭ ও ৭৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা মুমিন তথা আতœসমর্পনকারী মুসলিমদের জন্য আরো কিছু নির্দেশনা তুলে ধরেছেন। ৭৮ নম্বর আয়াতে এরশাদ করা হয়েছে এভাবে,
“আল্লাহ্র পথে জিহাদ করো যেমন জিহাদ করলে তার হক আদায় হয়।”
আল্লাহ তার বান্দাদের উদ্দেশ্য করে বলেন : আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করে তার রাসূলের মাধ্যমে তোমাদেরকে হেদায়েত দান করেছেন, তাই তার পথে চল, নিজেদের ঈমানকে শক্তিশালী করে তার দীন প্রচারের চেষ্টা করো। তবে এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো আমলের মধ্যে নিষ্ঠা থাকতে হবে ও কাজকর্ম হতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
৭৮ নম্বর আয়াতে জিহাদ শব্দটি কাফের ও কুপ্রবৃত্তি উভয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। হাদিসে এসেছে, রাসুল সা. একবার একটি যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে সাহাবিদের উদ্দেশ্য করে বলেন : আমরা জিহাদে আসগর বা ছোট জিহাদ থেকে জিহাদে আকবর বা বড় জেহাদে ফিরে এলাম। এ সময় সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করেন : বড় জেহাদ কি? তিনি বলেন : নফ্স বা কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জেহাদ।
এ আয়াতে আরো বলা হয়েছে : আল্লাহ ইসলাম এবং আদিপিতা ইবরাহীমের দীনকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং এ দীনে তোমাদের জন্য কঠিন কোনো দায়িত্ব নেই। যেসব দায়িত্ব ও কর্তব্য এতে আছে তা মানুষের সাধ্যের বাইরে নয়। যেমন- নামাজ বাধ্যতামূলক হলেও একটি সহজ কর্তব্য। নামাজকে এতটাই সহজ করা হয়েছে যে, অসুস্থ ব্যক্তি শোয়া অবস্থায় সরাসরি রুকু-সেজদা না করে ইশারায় নামাজ আদায় করতে পারবে। এ ছাড়া, যারা অসুস্থ ও শারিরীকভাবে অক্ষম তাদেরকে ইসলাম রোজা রাখতে বাধ্য করা হয় নি। আর যাদের অর্থনৈতিক ও শারীরিক সামর্থ্য আছে শুধুমাত্র তাদের উপর হাজ্জ ওয়াজিব করা হয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এ ধর্ম আল্লাহ্র ইবাদতের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম ধর্ম। এ ধর্মে আল্লাহ্র রাসুল সা. মুমিনদের জন্য আদর্শ এবং প্রকৃত মুমিনরা গোটা মানবজাতির জন্য আদর্শ। এ মর্যাদা রক্ষা করতে হলে নির্দেশ অনুযায়ী নামাজ পড়তে ও জাকাত দিতে হবে এবং নিজেকে আল্লাহর খাঁটি বান্দায় পরিণত করতে হবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
১. আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সব ধরনের অবহেলা ও অলসতা থেকে দূরে থাকতে হবে।
২. ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে এটিকে সহজ ও পালনযোগ্য করে তুলে ধরতে হবে, অপরকে ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা বা এক্ষেত্রে কঠোর হওয়া যাবে না।
৩. শুধুমাত্র মুখে ঈমান এনে নামমাত্র মুসলমান হলে চলবে না। কারণ আমল ছাড়া ঈমানের কোন গুরুত্ব নেই।
সুরা হা-মীম-আস সাজদার ৩৩নম্বর আয়াতের মুসলিম-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে এভাবে,
“তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার, যে ব্যক্তি আল্লাহ্র দিকে আহবান করে, সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং বলে, আমি একজন মুসলিম (আমি একজন আজ্ঞাবহ)।”
আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী মুসলিম-এর ব্যাখ্যায় বলা যায় যে, কোনো ব্যক্তির আল্লাহ্কে রব হিসাবে স্বীকার করে সোজা পথ তথা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলকে যে পথের কথা বলেছেন সেটাকেই বুঝানো হয়েছে তথা আত্মসমপর্ণকারী মুসলিমের কথাই বুঝানো হয়েছে এবং তারাই এ কাজ করে যারা একমাত্র কুরআন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সহীহ সুন্নাহর অনুসারী। মুসলিম জাতির মত বা পথ একটিই, সেটা হলো সহজ, সরল, সোজা পথ।
সূরা আন নামল-এর ৯১ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন এভাবে, (“হে মুহাম্মদ! তাদেরকে বলো,) আমাকে তো হুকুম দেয়া হয়েছে, আমি যেনো এই শহরের রবের ইবাদত করি, যিনি একে হারাম (সম্মানিত ঘোষণা) করেছেন এবং যিনি সব জিনিসের মালিক। আমাকে মুসলিম হয়ে থাকার।”
রাব্বুল আলামিন উপরোক্ত আয়াতে সুস্পষ্ট করে স্বয়ং আল্লাহ্র রাসুলুল্লাহ্ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে মুসলিম থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। একই সাথে আল্লাহ্র রাসুলুল্লাহ্ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে “এ শহরের রবের ইবাদত করার হুকুম দেয়া হয়েছে।” একই সঙ্গে এ রবের যে বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে তা এই যে, তিনি একে সুরক্ষিত ও পবিত্রতম স্থানে পরিণত করেছেন। এর উদ্দেশ্য মক্কার কাফেরদেরকে এই মর্মে সতর্ক করে দেয়া যে, চরম অশান্তি, হানাহানি, যুদ্ধ-সংঘাত ও রক্তপাত বিধ্বস্ত আরব ভূখ-ের এ শহরকে শান্তি ও নিরাপত্তার কেন্দ্রেভূমিতে পরিণত করে যে আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি এ বিপুল অনুগ্রহ করেছেন এবং যাঁর অনুগ্রহে তোমাদের এ শহর সমগ্র আরব দেশে ভক্তি ও শ্রদ্ধার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, তোমরা তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হতে চাইলে হতে পারো, কিন্তু আমাকে তো হুকুম দেয়া হয়েছে, আমি যেনো তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দায় পরিণত হই এবং তাঁর সামনেই নিজের বিনয় ও ন¤্রতার শির নত করি। তোমরা যাদেরকে উপাস্য বানিয়েছো তাদের কারো এ শহরকে হারামে পরিণত করার এবং আরবের যুদ্ধপ্রিয় এ লুটেরা গোত্রগুলোকে এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে বাধ্য করার ক্ষমতা ছিল না। অতএব আসল অনুগ্রহকারীকে বাদ দিয়ে এমন সব সত্তার সামনে মাথা নত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় আমার প্রতি যাদের সামান্যতমও অনুগ্রহ ও অবদান নেই।
মুসলিমদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
ইসলাম তথা আল্লাহ্র দীনকে প্রতিষ্ঠার কাজে অংশগ্রহণকে কুরআন করিমের অধিকাংশ স্থানে “আল্লাহকে সাহায্য করা” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি অবশ্যই একটি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ বিষয়। জীবনের যে পরিসরে আল্লাহ্ মানুষকে ইচ্ছা ও সংকল্পের স্বাধীনতা দান করেছেন সেখানেই তিনি নিজের উলুহিয়াতের শক্তি ব্যবহার করে কুফর বা ঈমান, বিদ্রোহ বা আনুগত্যের মধ্য থেকে কোনো একটির পথ অবলম্বন করার জন্য মানুষকে বাধ্য করেন নি। এর পরিবর্তে তিনি যুক্তি ও উপদেশের সাহায্য নিয়েছেন। এভাবে তিনি মানুষের কাছ থেকে এ স্বতস্ফুর্ত স্বীকৃতি আদায় করতে চেয়েছেন যে, অস্বীকৃতি, নাফরমানী ও বিদ্রোহ করার স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও তার জন্য নিজের স্রষ্ট্রার দাসত্ব, আনুগত্য ও বন্দেগীর পথ অবলম্বন করাই প্রকৃত সত্য সঠিক পথে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করাই আল্লাহ্র কাজ। আর যেসব লোক এ কাজে আল্লাহ্কে সাহায্য করে তাদেরকেই আল্লাহর সাহায্যকারী গণ্য করা হয়েছে। আল্লাহ্র কাছে মানুষের এটিই সর্বোচ্চ মর্যাদা। নামায, রোজা এবং দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম-সাধনার মাধ্যমে সে আল্লাহ্র সাহায্যকারী ও সহযোগীর মহান মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। এ দুনিয়ায় রূহানী ও আধ্যাত্মিক উন্নতির শিখরে অভিষিক্ত হবার এটিই উচ্চতম মর্যাদা ও মকাম।
প্রতিটি মানুষেরও উচিত আল্লাহ্র সাহায্যকারী হওয়ার প্রচেষ্টা চালানো। এর মধ্য দিয়ে আল্লাহ্ মানুষ যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, যে কারনে সৃষ্টির সেরা বলেছেন, যে কারনে মানুষকে আল্লাহ্র খলিফা বলেছেন তার স্বার্থকতা প্রমাণিত হবে। হাওয়ারীগণ হযরত ঈসা আ.-এর আহবানে স্বতস্ফুর্তভাবে আল্লাহ্র সাহায্যকারী হওয়ার জন্য এগিয়ে এসে তারাই প্রমাণ করেছেন আল্লাহর দীনকে দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠা করার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে সূরা আলে ইমরান-এর ৫২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেছেন এভাবে, “যখন ঈসা অনুভব করলো, বনি ইসরাঈল কুফরী ও অস্বীকার করতে উদ্যোগী হয়েছে, সে বললো : “কে হবে আল্লাহ্র পথে আমার সাহায্যকারী?” হাওয়ারীগণ বললো : “আমরা আল্লাহ্র সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহ্র প্রতি ঈমান এনেছি। সাক্ষী থাকো, আমরা মুসলিম (আল্লাহ্র সামনে আনুগত্যের শির নতকারী)”।

আল্লাহ্র সামনে মুসলিমদের নীতি
আল্লাহ্ সুবহানু তা’আলা সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী একচ্ছত্র শাসক। তিনি নিজের ইচ্ছামতো যে কোনো হুকুম দেবার পূর্ণ এখতিয়ার রাখেন। তাঁর নির্দেশ ও বিধানের ব্যাপারে কোনো প্রকার উচ্চবাচ্য করার বা আপত্তি জানাবার কোনো অধিকার মানুষের নেই। তাঁর সমস্ত বিধান জ্ঞান, প্রজ্ঞা, যুক্তি, ন্যায়নীতি ও সার্বিক কল্যাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও ঈমানদার মুসলিম যুক্তিসংগত, ন্যায়ানুগ ও কল্যাণকর বলেই তার আনুগত্য করে না, বরং একমাত্র সর্বশক্তিমান প্রভু আল্লাহ্র হুকুম বলেই তার আনুগত্য করে। যে জিনিসটি তিনি হারাম করেছেন তা কেবল তার হারাম করে দেবার কারণেই হারাম হিসেবে গণ্য। ঠিক একইভাবে যে জিনিসটি তিনি হালাল করেছেন সেটির হালাল হবার পেছনে অন্য কোনো কারণ নেই, বরং যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ এসব জিনিসের মালিক তিনি নিজের দাসদের জন্য এ জিনিসটি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন বলেই এটি হালাল। তাই কুরআন করিম সর্বোচ্চ বলষ্ঠিতা সহকারে মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, কোনো বস্তুর হালাল ও হারাম হবার জন্য সর্বশক্তিমান প্রভু আল্লাহ্র অনুমোদন ও অননুমোদন ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো ভিত্তির আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। অনুরূপভাবে আল্লাহ্ যে কাজটিকে বৈধ গণ্য করেছেন সেটি বৈধ এবং যেটিকে অবৈধ গণ্য করেছেন সেটি অবৈধ, এছাড়া মানুষের জন্য কোনো কাজের বৈধ ও অবৈধ হবার দ্বিতীয় কোনো মানদ- নেই।
রাব্বুল আলামিন বনি ইসরাঈলীদের জন্য শনিবারের বিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলো যে, তারা শনিবারের দিনটিকে তাদের বিশ্রাম ও ইবাদত করার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখবে। এদিনে তারা পার্থিব কোনো কাজ এমন কি রান্না-বান্নার কাজও নিজেরা করতে পারবে না। এ প্রসংগে কড়া নির্দেশ জারী করে বলা হয়েছিলো, যে ব্যক্তি এই পবিত্র দিনের নির্দেশ অমান্য করবে তাকে হত্যা করা অবশ্য কর্তব্য হয়ে পড়বে (যাত্রাপুস্তক, ৩১ অধ্যায়, ১২-১৭ শ্লোক)। কিন্তু বনি ইসরাঈল নৈতিক ও ধর্মীয় অধঃপতনের শিকার হবার পর প্রকাশ্যে শনিবারের অবমাননা করতে থাকে। এমনকি তাদের শহরগুলোতে প্রকাশ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজ-কারবার চলতে থাকে।
এ প্রসঙ্গে কুরআন করিমের সূরা বাকারাহ্র ৮৩ নম্বর আয়াতটি দেখা যেতে পারে, “স্মরণ করো, যখন ইসরাঈল সন্তানদের থেকে আমি পাকাপোক্ত অংগীকার নিয়েছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো ইবাদত করবে না, মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকিনদের সাথে সদয় ব্যবহার করবে, লোকদেরকে ভালো কথা বলবে, নামায কায়েম করবে ও যাকাত দেবে। কিন্তু সামান্য কয়েকজন ছাড়া তোমরা সবাই অংগীকার ভঙ্গ করেছিলে এবং এখনো ভঙ্গ করে চলেছো।”
এমনকি শনিবারওয়ালারা নিষিদ্ধ দিনে সমুদ্রের মাছগুলো কৌশলে ধরে ধরে খেতো। মাছগুলো গভীর সমুদ্র থেকে সাগরের উপকূলের কাছে চলে আসতো তাওরাত শোনার জন্য, এসময় এই অবাধ্য লোকজন জাল দিয়ে, বাঁধ দিয়ে মাছগুলোকে আটকিয়ে রাখতো এবং পরদিন অর্থাৎ রবিবারে মাছগুলো ধরে ধরে খেতো।
এজন্যই আল্লাহ্ তা’আলা মুসলিমদের নীতি কি হওয়া উচিত তা কুরআন করিমের সুরা আল মায়েদা-এর ১ নম্বর আয়াতে নির্দিষ্ট করে এরশাদ করেছেন এভাবে,
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা বন্ধনসমূহ পুরোপুরি মেনে চলো। তোমাদের জন্য গবাদি পশু শ্রেণিভুক্ত সব পশু হালাল করা হয়েছে, তবে সামনে যেগুলো সম্পর্কে তোমাদের বলে দেয়া হবে সেগুলো ব্যতিত। কিন্তু ইহ্রামের অবস্থায় তোমরা শিকার করা নিজেদের জন্য হালাল করে নিও না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করেন আদেশ দেন।”

প্রতিটি শিশু মুসলিম হয়ে জন্মগ্রহণ করে
মাতৃগর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করার সময় প্রতিটি শিশু মুসলিম হয়ে পৃথিবীতে আসে। এ প্রসঙ্গে রাব্বুল আলামিন কুরআন করিমের সুরা আর রূম-এর ৩০ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন এভাবে,
“অতএব (হে নবী এবং নবীর অনুসারীবৃন্দ) একনিষ্ঠভাবে নিজের মুখম-ল এ দীনের দিকে স্থির নিবন্ধ করো। আল্লাহ্ মানুষকে যে প্রকৃতির ওপর সৃষ্টি করেছেন তার উপর সুস্থির হয়ে যাও। আল্লাহ্র বানানো সৃষ্টি কাঠামো পরিবর্তন করা যেতে পারে না। এটিই পুরোপুরি সঠিক ও যথার্থ দীন। কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না।”
৩০ নম্বর আয়াতের সাথে সংগতি রেখে ৩১ নম্বর আয়াতে এরশাদ করা হয়েছে এভাবে, “(সুস্থির হয়ে যাও একথার ওপর) আল্লাহ্ অভিমুখী হয়ে এবং তাঁকে ভয় করো, আর নামায কায়েম করো এবং এমন মুশরিকদের অন্তরভুক্ত হয়ো না।”
সুরা আর রূম-এর ৩০ নম্বর আয়াতের মর্ম মতে, সত্য যখন তোমাদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেছে এবং তোমরা যখন জানতে পেরেছো এ বিশ^ জাহানের ও মানুষের ¯্রষ্টা, মালিক ও সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন শাসনকর্তা এক আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ নয়, তখন এরপর অপরিহার্যভাবে তোমাদের কার্যধারা এ ধরনের হওয়া উচিত।
কুরআন করিম এখানে ‘দীন’ শব্দটিকে যে বিশেষ অর্থে পেশ করছে এখানে ‘দীন’ শব্দটি সেই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে বন্দেগী, ইবাদত ও আনুগত্য লাভের একমাত্র অধিকার লা-শরীক আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো নেই। এতে আল্লাহ্র সার্বভৌম কর্তৃত্ব, গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকারে কাউকে তাঁর সাথে সামান্যতমও শরীক করা যাবে না। এখানে মানুষ নিজের ইচ্ছা ও আগ্রহ সহকারে একথা মেনে নেয় যে, সে তার সমস্ত জীবনে আল্লাহর পথনির্দেশ এবং তাঁর আইন মেনে চলবে।
“একনিষ্ঠভাবে নিজের মুখম-ল এ দীনের দিকে স্থিত নিবন্ধ করো” অর্থাৎ এরপর আর অন্যদিকে ফিরো না। জীবনের জন্য এ পথটি গ্রহণ করে নেবার পর অন্য কোনো পথের দিকে দৃষ্টিও দেয়া যাবে না। তারপর তোমাদের চিন্তা-ভাবনা হবে মুসলমানের মতো এবং তোমাদের পছন্দ-অপছন্দও হবে মুসলমানদের মতো। তোমাদের মূল্যবোধ ও মানদ- হবে তাই যা ইসলাম তোমাদের দেয়। তোমাদের স্বভাব-চরিত্র এবং জীবন ও কার্যক্রমের ছাঁচ ইসলামের চাহিদা অনুযায়ী হবে। ইসলাম যে পথে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনধারা চালাবার বিধান দিয়েছে তোমাদের সেই পথেই নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন পরিচালিত করতে হবে।
সমগ্র মানবজাতিকে এই প্রকৃতির ওপর সৃষ্টি করা হয়েছে যে, এক আল্লাহ্ ছাড়া তাদের আর কোনো ¯্রষ্টা, রব, মাবুদ ও আনুগত্য গ্রহণকারী নেই। এ প্রকৃতির ওপর তোমাদের অবিচল হয়ে যাওয়া উচিত। যদি স্বেচ্ছাচারীভাবে চলার নীতি অবলম্বন করো তাহলে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করবে। আর যদি অন্যের ইবাদতের শিকল নিজের গলায় পরে নাও তাহলেও নিজের প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাজ করবে।
রাসুল করিম সা.-এর বহু হাদিসে সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়েছে। “মাতৃগর্ভ থেকে জন্মলাভকারী প্রতিটি শিশু আসলে মানবিক প্রকৃতির ওপরই জন্মগ্রহণ করে। তারপর তার মাতা-পিতাই তাকে পরবর্তীকালে ইহুদি, খৃষ্টান ও অগ্নিপূজারী হিসেবে গড়ে তোলে। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে, যেমন প্রত্যেকটি পশুর পেট থেকে পুরোপুরি নিখুঁত ও সুস্থ পশুই বের হয়ে আসে। কোনো একটি বাচ্চাও কান কাটা অবস্থায় বের হয়ে আসে না।” পরে মুশরিকরা নিজেদের জাহেলী কুসংস্কারের কারণে তার কান কেটে দেয়।
এই মানবিক প্রকৃতির অর্থ হচ্ছে দীনের শিক্ষা, মুসলিম হয়ে মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে আগমন।
মুসনাদে আহমদ ও নাসায়ীতে বর্ণিত আর একটি হাদিসে বলা হয়েছে : এক যুদ্ধে মুসলমানরা শত্রুদের শিশু সন্তানদেরকেও হত্যা করে। নবী সা.-এর কাছে এ খবর পৌঁছে যায়। তিনি ভীষণ অসন্তুষ্ট হন এবং বলেন :
“লোকদের কি হয়ে গেছে, আজ তারা সীমা ছাড়িয়ে গেছে এবং শিশুদেরকেও হত্যা করছে?”
একজন জিজ্ঞেস করলো, এরা কি মুশরিকদের সন্তান ছিলো না? তিনি বলনে : “তোমাদের সর্বোত্তম লোকেরা তো মুশরিকদেরই আওলাদ।” তারপর বলেন : “প্রত্যেক প্রাণসত্তা প্রকৃতির ওপর জন্ম নেয়, এমনকি যখন কথা বলতে শেখে তখন তার মাতা-পিতা তাকে ইহুদি-খৃষ্টানে পরিণত করে।”
এন্য একটি হাদিসে ইমাম আহমদ র. “ইয়াদ ইবনে হিমার আলমুজাশিঈ রা. থেকে উদ্ধৃত করেছেন তাতে বলা হয়েছে, একদিন নবী সা. নিজের ভাষণের মাঝখানে বলেন :
“আমার রব বলেন, আমার সমস্ত বান্দাদেরকে আমি একনিষ্ট সত্যপথাশ্রয়ী করে সৃষ্টি করেছি, তারপর শয়তানরা এসে তাদেরকে দীন থেকে বিপদগামী করে এবং তাদের জন্য আমি যা কিছু হালাল করেছিলাম সেগুলোকে হারাম করে এবং তাদেরকে হুকুম দেয়, আমার সাথে এ জিনিসগুলোকে শরীক গণ্য করো, যেগুলোকে শরীক করার জন্য আমি কোনো সনদ নাযিল করি নি।”
আল্লাহ্ মানুষকে নিজের বান্দায় পরিণত করেছেন। কেউ চাইলেও এ কাঠামোয় কোনো পরিবর্তন সাধন করতে পারবে না। মানুষ বান্দা থেকে অ-বান্দা হতে পারে না। মানুষ নিজের জন্য যতোগুলো উপাস্য তৈরি করে নিক না কেনো, মানুষ যে এক আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো বান্দা নয় এ বাস্তব সত্যটি অকাট্য ও অবিচল রয়ে গেছে। মানুষ নিজের মূর্খতা ও অজ্ঞতার কারণে যাকে ইচ্ছে আল্লাহ্র গুণাবলী ও ক্ষমতার ধারক গন্য করতে পারে এবং যাকে ইচ্ছে নিজের ভাগ্য ভাঙা-গড়ার মালিক মনে করতে পারে। কিন্তু প্রকৃত ও বাস্তব সত্য এই যে, সার্বভৌম কর্তৃত্বের গুণাবলীর অধিকারী একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ নয়। কেউ তাঁর মতো ক্ষমতার অধিকারী নয় এবং মানুষের ভাগ্য ভাঙা-গড়ার শক্তিও আল্লাহ্ ছাড়া কারো নেই।
যে ব্যক্তিই স্বেচ্ছাচারিতার নীতি অবলম্বন করে নিজের প্রকৃত মালিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অথবা যে ব্যক্তিই অন্যের উপাসনার পথ অবলম্বন করে নিজের প্রকৃত রবের সাথে বিশ^াসঘাতকতা করেছে তার নীতি পরিহার করতে হবে। এবং প্রকৃতপক্ষে যে আল্লাহ্র বান্দা হিসেবে জন্মলাভ করেছে সেই এক আল্লাহ্র বন্দেগীর দিকে তাকে ফিরে যেতে হবে।
প্রতিটি মানুষের মনে এই ভয় জাগরুক থাকতে হবে যে, আল্লাহ্র জন্মগত বান্দা হওয়া সত্ত্বেও যদি তোমরা তার মোকাবিলায় স্বাধীনতার নীতি অবলম্বন করে থাকো অথবা তাঁর পরিবর্তে অন্য কারো বন্দেগী করে থাকো, তাহলে এ বিশ^াসঘাতকতা ও নেমকহারামির জন্য তোমাদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। তাই তোমাদের এমন নীতি ও মনোভাব থেকে দূরে থাকা উচিত যা তোমাদের জন্য আল্লাহ্র আযাব ভোগ করাকে অবধারিত করে তোলে।
ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রতিটি মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করার পূর্বে আল্লাহ্ মানুষের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন। এই প্রতিশ্রুতি ছিলো আল্লাহ্কে নিজেদের একমাত্র রব হিসেবে মেনে চলার।
বিভিন্ন হাদিসে থেকে জানা যায়, এটি আদম আ.-এর সৃষ্টির সময়কার একটি ঘটনা। সে সময় একদিকে যেমন ফেরেশতাদের একত্র করে প্রথম মানুষটিকে সিজদা করানো হয়েছিলো এবং পৃথিবীতে মানুষের খেলাফতের কথা ঘোষণা করা হয়েছিলো, অন্যদিকে ঠিক তেমনি কিয়ামত পর্যন্ত আদমের যে অগনিত সংখ্যক বংশধর জন্মলাভ করবে আল্লাহ্ তাদের সবাইকে একই সাথে সজীব ও সচেতন সত্তায় আবির্ভূত করে নিজের সামনে উপস্থিত করেছিলেন এবং তাদের কাছ থেকে তাঁর রব হবার ব্যাপারে সাক্ষ গ্রহণ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে রাব্বুল আলামিন কুরআন করিমের সুরা আল আ’রাফ-এর ১৭২ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন এভাবে,
“আর হে নবী! লোকদের স্মরণ করিয়ে দাও সেই সময়ের কথা যখন তোমাদের রব বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করেছিলেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের ওপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন : “আমি কি তোমাদের রব নই?” তারা বলেছিল : “নিশ্চয়ই তুমি আমাদের রব, আমরা এর সাক্ষ্য দিচ্ছি।” এটা আমি এজন্য করেছিলাম যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা না বলে বসো, “আমরা তো একথা জানতাম না।”
এ প্রসঙ্গে হযরত উবাই ইবন কা’ব রা. সম্ভবত নবী সা. থেকে জ্ঞান লাভ করে যা কিছু বর্ণনা করেন তা এ বিষয়ের সবচেয়ে ভাল ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যা নিন্মরূপ :
“মহান আল্লাহ্ সবাইকে একত্র করেন। (এক এক ধরনের বা এক এক যুগের) লোকদেরকে আলাদা আলাদা দলে সংগঠিত করেন। তাদেরকে মানবিক আকৃতি ও বাকশক্তি দান করেন। তারপর তাদের থেকে অংগীকার গ্রহণ করেন। তাদেরকে নিজেদের ওপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করেন : ‘আমি কি তোমাদের রব নই?’ তারা বলে : ‘অবশ্যই তুমি আমাদের রব।’ তখন আল্লাহ্ বলেন : ‘কিয়ামতের দিন যাতে তোমরা না বলতে পারো আমরা তো একথা জানতাম না, তাই আমি তোমাদের ওপর পৃথিবী ও আকাশ এবং তোমাদের পিতা আদমকে সাক্ষী করছি। ভালভাবে জেনে রাখো, আমি ছাড়া ইবাদাত লাভের যোগ্য আর কেউ নেই এবং আমি ছাড়া আর কোনো রব নেই। তোমরা আমার সাথে আর কাউকে শরীক করো না। আমি তোমাদের কাছে আমার নবী পাঠাবো। আমার সাথে তোমরা যেসব অংগীকার করছো তারা সেসব তোমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে। আর তোমাদের প্রতি আমার কিতাব নাযিল করবো।’ একথায় সমস্ত মানুষ বলে ওঠে : ‘আমরা সাক্ষ দিচ্ছি, তুমিই আমাদের রব, তুমিই আমাদের মাবুদ, তুমি ছাড়া আমাদের আর কোনো রবও মাবুদ নেই।”
সূচনায় সমস্ত মানুষ ছিলো একই উম্মত
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, মাতৃগর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করার সময় প্রতিটি শিশু মুসলিম হয়ে পৃথিবীতে আসে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে পরিবারের পিতা-মাতা, পরিবারের সদস্যসহ পারিপাশির্^ক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে সে ধর্মের প্রতি দীক্ষা গ্রহণ করে। শিশুর বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে বিভিন্ন বিভ্রান্তিতে জড়িয়ে নিজেকে সেই বিভ্রান্তির সাথে জড়িয়ে প্রকৃত ধর্ম থেকে দূরে ছিটকে পড়ে। সাধারণভাবে এখনো লোকেরা এ বিভ্রান্তিজনিত জটিল সমস্যায় ভুগছে। কুরআন করিম নাযিল হওয়ার সময়ও এ সমস্যাটি তাদের সামনে ছিলো। সমস্যাটি হচ্ছে, দুনিয়াতে বহু ধর্ম রয়েছে এবং প্রত্যেক ধর্মের লোকেরা তাদের নিজেদের ধর্মকে সত্য মনে করে। এ অবস্থায় এগুলোর মধ্যে কোনটি সত্য এবং কোনটি মিথ্যা তা কেমন করে যাচাই করা যাবে? এ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, এ ধর্মবিরোধ ও মতপার্থক্য আসলে পরবর্তীকালের সৃষ্ট। শুরুতে সমগ্র মানবগোষ্ঠি একই ধর্মের অনুসারী ছিলো। সেটিই ছিলো সত্য ধর্ম। তারপর এই সত্যের ব্যাপারে মতবিরোধ করে লোকেরা বিভিন্ন আকিদা-বিশ^াস ও ধর্ম গড়ে তুলতে থাকে।
দুনিয়ার এ জীবনটাতো পরীক্ষার জন্য। এখানে সত্যকে না দেখে বুদ্ধি-বিবেচনার সাহায্যে তাকে চিনে নেয়ার পরীক্ষা হয়ে থাকে। এই পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয় তারাই প্রকৃত মানুষ। মূলত ‘দীন’ হিসেবে ইসলামকে যারা চিনতে পারে এবং ইসলামের ছায়া তলে আশ্রয় নেয়। আর তারাই হচ্ছে মুসলিম।
এ প্রসঙ্গে কুরআন করিমের সুরা ইউনুস-এর ১৯ নম্বর আয়াতে রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেছেন এভাবে,
“সূচনায় সমস্ত মানুষ ছিলো একই উম্মত। পরবর্তীকালে তারা বিভিন্ন আকীদা-বিশ^াস ও ধর্ম-মত তৈরি করে নেয়। আর যদি তোমার রবের পক্ষ থেকে আগেভাগেই একটি কথা স্থিরীকৃত হয়ে না থাকতো তাহলে যে বিষয়ে তারা পরস্পর মতবিরোধ করছে তার মীমাংসা হয়ে যেতো।”
এখানে একথাটাই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, এ ধর্মবিরোধ ও মতপার্থক্য আসলে পরবর্তীকালের সৃষ্ট। শুরুতে সমগ্র মানবগোষ্ঠি একই ধর্মের অনুসারী ছিলো। সেটিই ছিলো সত্য ধর্ম।

মৃত্যু পর্যন্ত মুসলিম থাকার আহবান
প্রতিটি মানবকে মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত আল্লাহ্র প্রতি, আল্লাহ্র দীনের প্রতি অনুগ্রহ ও বিশ^স্ত থাকতে হবে। এখানে আল্লাহ্র প্রতি লিখলেই হতো, কিন্তু তার সাথে জুড়ে দিয়েছি আল্লাহ্র দীনের প্রতি। আল্লাহ্র ‘দীন’ বলতে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্ম।
এপ্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা কুরআন কারিমের সূরা আলে ইমরান-এর ১০২ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন এভাবে,
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহ্কে ভয় করো। মুসলিম থাকা অবস্থায় ছাড়া যেন তোমাদের মৃত্যু না হয়।”
আল্লাহ্র দীন এবং মুসলিম শব্দ দুইটি পরস্পর অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। আল্লাহ্র ‘দীন’ ছাড়া মুসলিম হওয়া যাবে না, তেমনি মুসলিম হতে হলে তাকে অবশ্যিই আল্লাহ্র দীনকে মানতে হবে, আল্লাহ্র দীনের অনুগত হতে হবে।
এপ্রসঙ্গে আরো বলা যেতে পারে, ‘দীন’ হচ্ছে আল্লাহ্র রজ্জু। আল্লাহ্র দীনকে রজ্জুর সাথে তুলনা করার কারণ হচ্ছে এই যে, এটিই এম একটি সম্পর্ক, যা একদিকে আল্লাহর সাথে ঈমানদারদের সম্পর্ক জুড়ে দেয় এবং অন্যদিকে সমস্ত ঈমানদারদেরকে পরস্পরের সাথে মিলিয়ে এক জায়গায়, এক জামায়াতে আবদ্ধ করে। এই রজ্জুকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরার মানে হচ্ছে, মুসলমানরা ‘দীন’-কেই আসল গুরুত্বের অধিকারী মনে করবে, তার ব্যাপারেই আগ্রহ পোষণ করবে, তাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালাবে এবং তারই খেদমত করার জন্য পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করবে। যেখানেই মুসলমানরা দীনের মৌলিক শিক্ষা ও দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ থেকে বিচ্যুৎ হয়ে পড়বে এবং তাদের সমগ্র দৃষ্টি ও আগ্রহ ছোটখাট ও খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হবে সেখানেই অনিবার্যভাবে তাদের মধ্যে সে একই প্রকারের দলাদলি ও মতবিরোধ দেখা দেবে, যা ইতিপূর্বে বিভিন্ন নবীর উম্মতদেরকে তাদের আসল জীবন লক্ষ থেক বিচ্যুৎ করে দুনিয়া ও আখেরাতের লাঞ্ছনার আবর্তে-নিক্ষেপ করেছিল।
মুসলিমদের প্রতি সকল আসমানী কিতাবের ওপর ঈমান আনার নির্দেশ
আল্লাহ্ তা’আলা সকল মুসলিমকে সকল আসমানী কিতাবের উপর ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামের মৌলিক বিধানের মধ্যেও রয়েছে সকল আসমানী কিতাবের উপর ঈমান আনার। কোনো আসমানী কিতাবের ওপর ঈমান না আনলে কেউ মুসলিম হতে পারবে না, এটা আল্লাহ্র স্পষ্ট ঘোষণা। যে নির্দেশটি শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মতের জন্য প্রযোজ্য তেমনিভাবে অন্যান্য নবীদের উম্মতের জন্যও প্রযোজ্য। আল্লাহ্ তা’আলা শেষ নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যেমন আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন, তেমনিভাবে এর আগের নবীদের উপরও আসমানী কিতাব নাযিল করেছিলেন। অথচ আহলে কিতাবীরা কেউ কেউ শেষ নবীর উপর নাযিল করা আসমানী কিতাবকে অস্বীকার করেছে, শেষ আসমানী কিতাবের উপর ঈমান আনে নি। আবার কেউ কেউ তাদের সামনে যখন আল্লাহ্র পক্ষ থেকে পূর্ববর্তী কিতাবগুলোকে সত্যায়িত করে এই শেষ কিতাবটি এলো তখন তারা কোনোরূপ জিদ, হঠকারিতা ও সংকীর্ণ স্বর্থপ্রীতির আশ্রয় নেন নি এবং তাকেও ঠিক আন্তরিকতা সহকারে স্বীকার করে নিলেন যেমন পূর্ববর্তী কিতাবগুলোকে স্বীকার করতেন।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ সুবহানু তা’আলা সূরা আল ‘আনকাবূত-এর ৪৭ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন এভাবে, “(হে নবী!) আমি এভাবে তোমার নিকট কিতাব নাযিল করেছি, এজন্য যাদেরকে আমি প্রথমে কিতাব দিয়েছিলাম তারা এতে ঈমান আনে এবং এদের অনেকেও এর উপর ঈমান আনছে আর আমার আয়াতসমূহ কেবলমাত্র কাফেররাই অস্বীকার করে।”
উপসংহার
উপরের আলোচনা থেকে আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে দুনিয়ার আদি মানব-মানবী ছিলেন হযরত আদম আ. ও মা হাওয়া আ.। তাঁদের ধর্ম ছিলো ইসলাম, আর তাঁরা ছিলেন মুসলিম। আর একারনেই বলতে দ্বিধা নেই যে, পৃথিবীর আদি ও অকৃত্রিম ধর্ম ইসলাম। আর আদি মানুষ ছিলেন মুসলিম। হযরত আদম আ.-এর পরবর্তীতে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বা দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী, রাসুল, পয়গম্বর আগমন করেছিলেন তারা সবাই ছিলেন মুসলিম, তাদের ধর্ম ছিলো ইসলাম। কিন্তু কালে কালে, যুগে যুগে, শতাব্দীতে শতাব্দীতে মানুষের শাখা প্রশাখা সৃজিত হয়েছে, তাদের আকিদা বিশ^াস, ধর্ম আলাদা হয়েছে, তাদের পরিচিতি হয়েছে পৃথক।
একথা এখানে স্পষ্ট করে বলা যায় যে, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মতেরাই শুধুমাত্র মুসলিম নয় এবং তাদের ধর্মই শুধু ইসলাম নয়।
ভুলে গেলে চলবে না প্রতিটি মানুষ আল্লাহ্র কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই প্রতিশ্রুতি ছিলো আল্লাহ্কে নিজেদের একমাত্র রব হিসেবে মেনে চলার, একমাত্র সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মেনে চলার, একমাত্র মাবুদ হিসেবে মেনে চলার, আল্লাহ্র একমাত্র দীনকে মেনে চলার এবং মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরণ করার। যা কুরআন কুরিমের সুরা আল আ’রাফ-এর ১৭২ নম্বর আয়াতে স্পষ্ট করে এরশাদ করা হয়েছে।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা আরো দেখতে পাই, আল্লাহ্ সুবহানু তা’আলার দীন হচ্ছে ‘ইসলাম’। ইসলাম হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান ও জীবনপদ্ধতি। মানুষ দুনিয়ায় যে আইন ও নীতিমালার ভিত্তিতে তার সমগ্র চিন্তা, দর্শন ও কর্মনীতি গড়ে তোলে তাকে বলা হয় ‘দীন’। যারা আল্লাহ্র বেধে দেওয়া জীবনপদ্ধতি ও জীবনবিধান মেনে চলে তারাই ইসলামের অনুসারী। এই ‘দীন’ তথা ইসলামের অনুসারীরাই ‘মুসলিম’।
রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে তোমার একনিষ্ট মুসলিম হিসেবে কবুল করে নাও, মুসলিম হিসেবেই শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করার মনের বাসনাকে কবুল করুন। আমিন, ইয়া রাব্বুল আলামিন।

লেখক : গবেষক, ইতিহাস লেখক, সভাপতি, কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী।

সাহায্যকারী গ্রন্থ :
তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী র., অনুবাদ : আবদুল মান্নান তালিব। আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা।

Print Friendly, PDF & Email